ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ঢেউয়ের বন্ধুরা

নূর সিদ্দিকী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১২
ঢেউয়ের বন্ধুরা

রোদ নিয়ে এই গল্প হতে পারে। রোদ, রোদ্দুর।

আহা সোনা সোনা রোদ। এমন কত কথাই না বলা হয়। আজকের সকাল কেবল নয়; আলোকিত প্রতিটি সকালেই এমন রোদ থাকে। দিনের বিভিন্ন সময়ে রোদের তীব্রতার মাত্রা অবশ্য একটু এদিক-ওদিক হয়। এটা স্বাভাবিক ঘটনা।

গল্পের প্রধান চরিত্র হিসেবে রোদ তাই খুবই মানানসই একটা বিষয়। আমার এই ধারণাটা আরও বেশি পোক্ত করেছে ঢেউ। ওহহো, ঢেউ কে তাতো আপনাদের বলা হয়নি। ঢেউ হলো আমার মেয়ে। খুব সকালেই ওর ঘুম ভাঙে। আমারও আগে সে জেগে ওঠে।   ওর এই অভ্যাসের পেছনে রোদের ভূমিকাই সবচে বেশি। তবে কেবল রোদ নয় এই গল্পে ফড়িংয়ের কথাও  তোমাদের বলবো আমি।

তিনতলায় আমাদের বাসা। আর আমাদের বেডরুমটা পূব দিকে খোলা। বড় বড় দুটো জানালায় মোটা পর্দা আছে। ঢেউয়ের জন্মের পর আর আমি ওই পর্দা টেনে দিতে পারিনি। ঘরটা একটু অন্ধকার হলেই ওর কান্না শুরু হতো। ওর জন্ম হয়েছে ক্লিনিকে। চারদিন বয়সে বাসায় এসেই ঢেউ তার সবচে অপছন্দের বিষয়টি আমাদের জানান দিয়েছিল। আর সেটি হচ্ছে বেডরুমের পর্দাটা। আমার এক ফুপি ঢেউকে দেখতে এসে ঘোষণা করলো ঘরে খুব বেশি আলো-হাওয়া ঢুকতে দেয়া যাবে না- এতে নাকি কু-বাতাস, কু-আলো আসবে, বোঝেন অবস্থা। ফুপির কথা আমাকে মানতেই হলো। বিকেলের দিকে আমি পর্দাটা টেনে দিতেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে ঢেউ। কান্নাই ছিল তখন তার একমাত্র ভাষা। তবে সে বিছানা ভিজিয়ে দিয়েও প্রতিবাদ জানাতে শেখে ক’দিন যেতে না যেতেই।

ওই বিকেলে পর্দাটা সরিয়ে দিতেই আমার চারদিন বয়েসী মেয়ে ঢেউ হেসে ওঠে। ঢেউয়ের এই আচরণে আমার ফুঁপি বিরক্ত হন। আর এখন তো ঢেউয়ের সারাদিনই কাটে রোদের সাথে। ওই যে বলেছি, খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙে। সূর্যমামা উঁকি দিলেই আমার ঘরে ঢেউয়ের বিছানায় রোদ খেলতে শুরু করে। ব্যাস আর যায় কোথায়, রোদের ডাকে কি ঢেউ সাড়া না দিয়ে পারে? শুরু হয় খেলা। ঢেউয়ের মুখে শরীরেও রোদ হাত বুলিয়ে দেয়।

দুপুরের দিকে রোদের মেজাজ একটু তেঁতে উঠলে ঢেউয়ের মনও খারাপ হয়। সে ঘুমিয়ে নেয় ক্ষাণিকক্ষণ। আবার বিকেল হলে রোদ আর ঢেউ হেসে খেলে সময় কাটায়।  

সেদিন রাতে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। আমার ধারণা এই বৃষ্টি দুই তিন দিনের আগে থামবে না। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামছে, ইস্ এখন আমরা কেন যে ঢাকায়। এই বৃষ্টির সময় আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকলে টিনের চালে বৃষ্টির ফোটা পড়ার শব্দগুলো অসাধারণ লাগতো। ছোটবেলায় তো আমি বৃষ্টির রাতে ঘুমাতামই না। শব্দ শুনতাম বৃষ্টির।

একটানা অনেকক্ষণ বৃষ্টিপড়ার শব্দ শুনলে মনে হতো একেকটা ফোটার শব্দ একেকরকম। আর সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম সুর বা ছন্দ তৈরি হতো। আমার মেয়ে ঢেউ এখনও বৃষ্টির শব্দ শুনতে পায়নি। অবশ্য বৃষ্টির কিছুটা ছাট আসে আমাদের ঘরের জানালায়। ঢেউ তখন খুব অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এর কারণ কিন্তু ভিন্ন। বৃষ্টি শুরু হলে ঢেউয়ের বন্ধু রোদ চলে যায়। ঢেউ মনে হয় এজন্য একটু কষ্টও পায়। রোদ তার বন্ধু আর সে চলে গেলে তো কষ্ট লাগবেই।

ঢেউয়ের বয়স এখন মাত্র চারমাস। সে বসতেও শেখেনি। ফলে রোদ এসে ঢেউয়ের শিয়রে বসে রোজ। আর সে শুয়ে শুয়ে তার সাথে খেলা করে। আমি খুব অবাক হই ওদের গল্প শুনে। আমি ঘরের কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে দেখি ওরা গল্প করছে। রোদের কথাবার্তা আমি শুনতে পাইনা, ঢেউয়েরটা শুনি। ঢেউ কথা বলে। তোমরা ভাবছো চারমাস বয়স সে আবার কথা বলে কিভাবে? আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমার মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো তুমিও ওই বয়সে কত্ত কথা বলেছো।  

সেদিন দেখলাম রোদ আর ঢেউ হাত ধরাধরি করে আছে। ঢেউ বলছে- আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে, বলেই সে হাসলো। রোদ বোধ হয় জবাবে বলেছে- আমি ঠিক তোমার হাসির মতই সুন্দর। ঢেউ বলছে- আমার মাও তাই বলেন, মা বলে, ঢেউ সোনার হাসিটা ঠিক সকালের রোদের মত। এরপর  ঢেউ অনেকক্ষণ ধরে হাসে। ওর হাসি আর থামতেই চায় না। আমি বুঝে ফেলি রোদ কি বলেছে। রোদ বোধ হয় বলেছিল- আচ্ছা এইযে তোমার আমার বন্ধুত্ব হলো, তোমার মা রাগ করছে না তো। তোমরাই বলো, রোদের এমন কথা শুনলে কার না হাসি পাবে।

আমাদের বাসার সামনে দুটো নারকেল গাছ আছে। ওই গাছে দুটো পাখির বাসা আছে। একদিন সকালে ঢেউয়ের ঘুম ভেঙেছে ভেবে উঠে দেখি না, সেতো ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা তাহলে অমন করে কাঁদলোটা কে। পরে দেখি পাখিদের ছানারা কাঁদছে। তাদের মা গেছে খাবার আনতে। আমিও খাবার তৈরি করতে গেলে ঢেউ কান্না করে। তবে সব সময় নয়, রাতে। দিনের বেলা তো সে রোদের সাথেই সময় কাটায়। তবে সন্ধ্যায় কি ঢেউয়ের মন খারাপ হয়। কারণ তখন রোদ চলে যায় তার মায়ের কাছে। সারাদিন খেলা করে তারও তো ক্লান্তি আছে। আর আমার মতই রোদের মাও তো তাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাবে। তবে এটা ঢেউ খুব বেশি মানতে পারে না। সে কান্না জুড়ে দেয়।

তোমরা যারা একটু বড়। মানে ঢেউয়ের চেয়ে বড়। তারা যে ফড়িংদের সাথে খেলা করতে পছন্দ করো তা কিন্তু জানি। তোমাদের মতই হয়েছে ঢেউ। এইতো গত সপ্তায় দেখলাম দুপুরে বৃষ্টির পর রোদ যখন ঘরে ঢোকার পথ খুঁজছে তখন একটা ফড়িং আমাদের ঘরের জানালায় বসে আছে। বৃষ্টিতে ওর পাখাগুলো একটু ভারি আর মলিন দেখাচ্ছিল। বোধ হয় সে একটু ক্লান্তও ছিল।

আমি বড় মানুষ ওর কাছে গেলে উড়ে যেতে পারে এই ভয়ে ঢেউকে কোলে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ঢেউ ওকে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও পরে হাত বাড়িয়ে দিল। ওমা একি কাণ্ড, ফড়িংটাও ওর ছোট আঙুলের ওপর বসে পড়লো। ততক্ষণে রোদও ঢেউয়ের হাত জড়িয়ে ধরেছে।   আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। দেখি না ওরা তিনজন কি করে। ঢেউ হাতটা লম্বা করে রেখেছে। আমার মনে হলে ফড়িংয়ের পায় ওকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

ঢেউ হাসছে। ফড়িংটা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে আছে। একবার আমার দিকে আর একবার ফড়িংয়ের দিকে তাকাচ্ছে ঢেউ। দেখতে দেখে রোদ ফড়িংয়ের গা থেকে পানিগুলো নিয়ে নিলো আর সে খুব চাঙা বোধ করলো। প্রথমে একটু নাচন দিলো ঢেউয়ের হাতের ওপরেই। তারপর ঢেউকে ঘিরে দিলো এক চক্কর। ঢেউ হাসছে। রোদ একটু মন খারাপ করলো। সে বোধ হয় ভেবেছে ঢেউ নতুন বন্ধু পেয়ে তাকে ভুলে যাবে। তাই কি হয়? আচ্ছা তোমরা কি পুরনো বন্ধুদের ভুলে যাও? না। তাহলে ঢেউ কেন তা করবে। ও তো তোমাদের মতই হচ্ছে।

এরপর ফড়িংটা চলে গেলো। সে নিশ্চয়ই তার বাসায় গিয়ে তার মাকে ঢেউয়ের কথা বলবে। সে বলবে- জানো মা আজকে না ঢেউসোনার সাথে দেখা হয়েছে, আমি তার ছোট্ট নরম আঙুলে বসেছি, কি যে ভাল লেগেছে। ঢেউ সোনার হাসিটা খুব সুন্দর ঠিক আমার পাখার মত। কত্ত রঙ ওর হাসিতে। মাগো আমি হাসলেও কি অমন সুন্দর লাগে। ফড়িংয়ের মা বলবে- হ্যাঁ বাছা ঠিক বলেছো তোমাদের সবার হাসিই সুন্দর।

এখন ঢেউ কেবল রোদের প্রতীক্ষায়ই থাকে না, ফড়িংকেও খোঁজে মনে মনে। আর তাই রোদ আর ফড়িং আসে আমাদের ঘরে, ঢেউয়ের কাছে।   ওরা খুব ভালো বন্ধু সারাদিন খেলা করে। আর ক’দিন পর ঢেউ যখন বসতে বসতে দাঁড়াতে শিখবে জানালার গ্রিল ধরে তখন যে কি মজাটাই সে পাবে, তোমরাও নিশ্চয় বুঝতে পারছো।


সম্পাদনা: আরিফুল ইসলাম আরমান, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি  ও শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক, স্বপ্নযাত্রা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।