বইমেলা থেকে অনেক বই এনেছি। একটি ভূতের বইও এনেছি।
বইটি হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে খুললাম আবার। মন দিয়ে একটা গল্প পড়ছি। ওমা বইয়ের পাতায় আঁকা ছবিটা কেমন জানি নড়েচড়ে ওঠলো! ভাবলাম আমার চোখের কোন সমস্যা। এদিক সেদিক তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলাম।
নাহ আঁকা ছবিগুলো কেমন জানি নড়াচড়া করছে। হাসছে। পাতায় আঁকা একটা ভূতের ছবি। ভূতের ঠোঁটটা কেমন নড়ে ওঠলো। আমি আঙুল দিয়ে ঘষা দিলাম। দেখি হাতে টের পাওয়া যায় কি না। না, সবতো দেখি ঠিকঠাকই আছে। তো ছবিটা এমন দেখাচ্ছে কেনো?
মনের ভুল হবে হয়তো। এসব মনে করে আবার পড়তে লাগলাম বইটি। একি! পাতায় আঁকা ভূতের একটা হাত লিকলিক করে লম্বা হয়ে আমার মুখের কাছে চলে এলো। তারপর আমাকে হালকাভাবে আদর করতে লাগল! আর ভূতের হাসিটাও ছিল খুব সুন্দর। মায়া মায়া হাসি। আমি খুব একটা ভয় পাইনি। ভূতের আঙুলগুলো খুব চমৎকার। তিনটা আঙুল। চিকন, লম্বা আর নরম তুলতুলে। মনে হচ্ছে একটা শিশু আমাকে আদর দিচ্ছে। আমি স্বপ্ন দেখছি নাকি!
ভূতের বড় মুখটা আরো বড় করে হাসি দিয়ে বলে, সুমা, তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে। আর আমি ভালো একটা ভূত। আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি। তুমি যখন এ বইটা কিনেছ তখনই মনে মনে বলেছি, সুমাকে আমি বন্ধু বানাবো। সে হবে আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি বললাম, তুমি কি সত্যি ভূত, না কার্টুন? ভূতটি বলল, আমি মিথ্যা বলি না। এ বইতে যতগুলো ভূতের ছবি আছে সবাই আমার বংশের ছেলে মেয়ে। এরা সবাই তোমাকে পছন্দ করবে। তুমি মোটেও ভয় পেয়ো না। সবাই তোমার বন্ধু হয়ে যাবে।
ভূতের নাম শুনলে ভয়ে হাত-পা কাপাকাপি শুরু হয়ে যায়। ভূত দেখলে মানুষ ভয়ে ছুটে পালায়। ভূতকে ভয় পায় না এমন লোক কি আছে? আর এখন আমি এগুলো কী শুনছি ভূতের মুখে! কি চমৎকার কথা! ভূত আমাকে পছন্দ করে। ভূত আমার বন্ধু। আমি মনে মনে হাসছি। আমার ভয় কমে গেছে। আমার খুব আনন্দ লাগছে। আমি বইয়ের আরেকটা পাতা ওল্টালাম। এ পাতায় একটা বড় ভূতের সাথে আছে তিনটা বাচ্চাভূত। পাতা ওল্টাবার সাথে সাথে ভূতের বাচ্চাগুলো খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি হাসিমুখে দেখছি ওসব।
বড় ভূতটা বলল, বেক্কলের মতো ভেটকি পাইরো না। সুমাকে সালাম দাও। ওরা হাসতে হাসতে বলল, এই ছেঁরি তুমি কি আমগোর ছেলাম নিবা? আমি বললাম, হ্যা নেবো? ওরা আমার কথা শুনে আবার হাসতে লাগল। বলে, ওমা, এই ছেঁরি জানি কেমনে কতা কয়। বেক্কল ছেরি।
তখন বড় ভূতটা খুব বিরক্ত হয়ে ওদের একটা ধমক মেরে বলল, এতো দুষ্টুমি করছো কেনো তোমরা? ও হলো সুমা। ভালো একটা মেয়ে। আমাদের সর্দার ওকে বন্ধু মেনেছে। বন্ধুকে সালাম দেও।
বাচ্চাগুলো খুব দুষ্টু দুষ্টু। ওরা শরীর বাঁকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে মুখ ভেংচিয়ে আমাকে বলে, এই ছেঁরি, থেলাম, থেলাম। ওদের দুষ্টুমি দেখে আমি হেসে ফেললাম। বড় ভূতটি বলল, ফাজলামি করছো কেনো? সেলাম দাও, হাত মেলাও। বাচ্চাগুলো একসাথে ওদের ছয়টি চিকন হাত লতার মতো বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি হাত মেলালাম। হাতমেলানোর সময় ওরা আমার হাতে একটা করে চিমটি কাটলো। ওরা আনন্দে নাচতে নাচতে বলল, সুমাপু আমরা তোমার কোলে ওঠবো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কোলে নাও। ওরা বইয়ের পাতায় দাঁড়িয়ে এসব বলছে।
দেখতে দুই ফিট লম্বা পুতুলের মতো। আমি বললাম, আরেকদিন কোলে নেবো তোমাদের। ওরা মাথা কাৎ করে হাসি দিয়ে বলে, ‘চিংচিং মিং নাফাং কুলুকুলু সুমাপু।
এভাবে সবকটি পাতার ভূতের সাথে আমার অনেক কথা হলো, মজার মজার কথা। সবাই আমার বন্ধু।
আমি বললাম, তোমরা কী খাও? ওরা বলে, আমারা ‘পড়া’ খাই।
মানে? মানে বুঝ না তুমি? যখন কেউ বইটি পড়ে তখন পড়া দেখেই আমাদের পেট ভরে যায়। বইটি পড়ে যখন বন্ধ করে রেখে দেয় তখন আমরা চ্যাপটা হয়ে পড়ে থাকি। তখন আমাদের কষ্ট হয়।
আমি বললাম, এতো কষ্ট করার দরকার কি? বই থেকে লাফিয়ে চলে যেতে পারো না জঙ্গলে?
ওরা বলে, পারি, কিন্তু আমরা তা করব না।
বললাম, তোমরা এতো কষ্ট করছো তবে পালাতে পারবে না কেন? বোকা।
ওরা বলে, এ বইয়ের গল্পের সাথে মিল রেখে শিল্পী আমাদের বানিয়েছেন। আমরা যদি পালিয়ে এখান থেকে চলে যাই তবে বইটির গল্প কেউ পড়বে না। আর গল্প না পড়লে মানুষ ভূত সম্পর্কে জানতেও পারবে না। এছাড়া যিনি আমাদের বানালেন তাঁর পারমিশন ছাড়া আমরা এক পা-ও নড়বো না। যত কষ্টই হোক। বুঝেছ এবার?
আমি ওদের কথা শুনে থ হয়ে গেলাম। আমি বললাম, সত্যিই তোমরা খুব ভালো ভূত। তোমরা আমার খুব বন্ধু। আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি।
আমি স্কুলের পড়া পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে খুব কাহিল হয়ে পড়ি। হঠাৎ কোনো কারণে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। তখন আমি মন খারাপ করে আর বসে থাকি না। চলে যাই বন্ধুর কাছে। ভূতের বইটা খুলি। ভূতের সাথে গল্প করি। দুষ্টুমি করি। ওরা অনেক সুন্দর করে গল্প করতে পারে। ওদের সাথে কথা বলে আমার মন একদম ভালো হয়ে যায়। ওরা কি চমৎকার বন্ধু আমার!
সম্পাদনা: আরিফুল ইসলাম আরমান, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি