ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

এবারের নোবেল পুরস্কারের গল্প

ইমরুল ইউসুফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১২
এবারের নোবেল পুরস্কারের গল্প

সুপ্রসিদ্ধ রসায়ন বিজ্ঞনী, সমাজ বিজ্ঞানী, বহু-ভাষাবিদ, ব্যবসায়ী, কবি ও চিরকুমার স্যার আলফ্রেড বার্নাড নোবেল (১৮৩৩-১৮৯৬) প্রবর্তন করেন নোবেল পুরস্কার। ডিনামাইটের আবিষ্কারক এবং জনক হিসেবে নোবেলকে বলা হয় ‘লর্ড ডিনামাইট’।

বিজ্ঞান ছিল নোবেলের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। তিনি মনে করতেন একমাত্র বিজ্ঞানই পারে মানুষকে সংস্কারমুক্ত, বাস্তবসম্মত উন্নত জীবনের সন্ধান দিতে। এই আত্মবিশ্বাস থেকেই নোবেল বিশ্ববাসীর কল্যাণে ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর এক উইলের মাধ্যমে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মানুষের উন্নয়নকর্মের স্বীকৃতির জন্য দান করে যান। নোবেলের উইল অনুসারে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হয়ে আসছে। পুরস্কারদাতার নাম অনুসারেই নাম হয়েছে ‘নোবেল পুরস্কার’।

নোবেল পুরস্কারের মতো এত সম্মানের এবং এত মোটা অংকের অর্থ পুরস্কার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। নোবেল মৃত্যুবরণ করার আগে ঘোষণা করেছিলেন, পুরস্কারটি দাতা সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী পৃথিবীর যে কোনো জাতির মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য লাভ করতে পারবে। তার নির্দেশ বা উইল অনুযায়ী ১৯০১ সাল থেকে ৫টি বিষয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে আরো ১টি বিষয়ে মোট ৬টি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। বিষয়গুলো হলো- পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতি। চলতি বছরের পুরস্কারের অর্থমূল্য বাবদ ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের হাতে পুরস্কার হিসেবে তুলে দেয়া হবে। নোবেল পুরস্কার ২০১২ প্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো।

পদার্থবিদ্যা : কোয়ান্টাম অপটিকস নিয়ে গবেষণার জন্য চলতি বছর পদার্থবিদ্যায় এবছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফ্রান্সের সার্জ হ্যারোশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড। এই দুই বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, কী করে আলোর কণাকে এর একেবারে মৌলিক অবস্থানে (কোয়ান্টাম স্টেট) রেখেই পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা আগে ‘অসম্ভব’ বলে মনে করা হতো। এ পুরস্কারের জন্য তাদের নাম ঘোষণা করে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস বলেছে, এই দুই বিজ্ঞানীর গবেষণায় কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায় এক নতুন দুয়ার খুলে গেছে, যার পথ ধরে অতি উচ্চগতির কম্পিউটার তৈরির গবেষণা শুরু করা সম্ভব হয়েছে। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়তো চলতি শতকেই আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে পুরোপুরি বদলে দেবে, যেমনটা গত শতকে দিয়েছিল আমাদের চেনা সাধারণ কম্পিউটার।

রসায়নশাস্ত্র : মানব দেহের লক্ষ্য-কোটি কোষ যে প্রক্রিয়ায় নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে সেই রসায়ন নিয়ে গবেষণার জন্য এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই গবেষক। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমী অফ সায়েন্স রসায়নে চলতি বছরের নোবেল পুরস্কারের জন্য রবার্ট জে লেফকোইৎজ ও ব্রায়ান কে কোবিলকার নাম ঘোষণা করে। তাদের পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেছে, তারা গবেষণা করেছেন মূলত কোষের উপরিভাগে বিদ্যমান প্রাপক বা গ্রাহক (রিসেপ্টর বা রিসিভার) সম্পর্কে। এর মূল কাজ হচ্ছে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া। একগুচ্ছ জি-প্রোটিন কাপলড-রিসেপ্টর চিহ্নিতকরণে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য তাদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। মানুষের শরীরের অবকাঠামো কোটি কোটি কোষের সমন্বয়ে ইন্টার-একশনরত এক হারমোনিক বা ফাইন-টিউনড সিস্টেম প্রতিটি কোষেই অবস্থান করে একটি ক্ষুদ্র রিসেপ্টর বা রিসিভার, যার কাজই হলো যেকোনো পরিবেশে তার ইন্দ্রিয়কে সচল করা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই পরিবেশে নিজেকে ত্বরিতগতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়া। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য বাবদ ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার ভাগ করে নেবেন এই দুই বিজ্ঞানী।

চিকিৎসাবিজ্ঞান : স্টেম সেল নিয়ে গবেষণার জন্য এ বছর চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ব্রিটেনের জন বি গার্ডন ও জাপানের শিনিয়া ইয়ামানাকা। এবারের বিজয়ী হিসেবে তাদের নাম ঘোষণা করে সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই দুই গবেষক দেখিয়েছেন, প্রাপ্তবয়ষ্ক বিশেষায়িত কোষকে কীভাবে স্টেম সেলে রূপান্তর করা যায়, যাতে করে তা থেকে যে কোনো অঙ্গের জন্য নতুন কোষ তৈরি করা যায়। তাদের অনন্য সাধারণ এই উদ্ভাবন বিভিন্ন ধরনের দেহকোষের বেড়ে ওঠা ও কজের ধরন নিয়ে আমাদের ধারণা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। এক ধরনের দেহকোষ থেকে (যেমন- ত্বক, হৃৎপি- বা ফুসফুসের কোষ) কেবল ওই ধরনের কোষই তৈরি করা যায়- এমন ধারণা ১৯৬২ সালে এক গবেষণায় ভেঙে দেন জন বি গার্ডন। অন্ত্রের কোষ থেকে তিনি ব্যাঙের ক্লোন তৈরি করেন, যা পরে একটি স্বাভাবিক ব্যাঙ হিসেবে বেড়ে ওঠে। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, তাদের ওই গবেষণার ভিত্তিতে এখন রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ওই গবেষণার প্রায় ৪০ বছর পর শিনিয়া ইয়ামানাকা দেখান, কেবল চারটি জিন বদলে দিলেই ইঁদুরের প্রাপ্তবয়স্ক কোষ থেকে এমন স্টেম সেল তৈরি করা যায়, যা থেকে দেহের অন্য অঙ্গের জন্য প্রয়োজনীয় কোষ তৈরি সম্ভব।

সাহিত্য : এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন চীনের মো ইয়েন। মো ইয়েন চীনের কাফকা হিসেবে পরিচিত। ৫৭ বছর বয়সী মো ইয়েন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রথম নাগরিক। সুইডিস একডেমী তার নোবেল দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছে, অলীক অনুসন্ধিৎসু কল্পকথার সঙ্গে ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতার সম্মিলন ঘটেছে তার লেখনীতে। দৃষ্টির সুতীক্ষè তির্যকতা দিয়ে তিনি ইতিহাস, পৌরাণিকতা আর আধুনিকতার সম্মিলন ঘটিয়েছেন। তার লেখা অনন্য এক উপায়ে আমাদের অন্তদৃষ্টিকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। তার লেখা জটিলতায় পরিপূর্ণ। তিনি উদ্ভট কল্পনা এবং বাস্তবতার মিশ্রণ ঘটিয়ে আমাদের অন্য এক জগতে নিয়ে যান। সেই জগতে তিনি মনে করিয়ে দেন বিশ্বখ্যাত আরো দুজন লেখক উইলিয়াম ফকনার ও গ্রাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কথা। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- দ্য গারলিক ব্যালাডস (১৯৯৫), এক্সপ্লোশানস অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, দ্য রিপাবলিক অব ওয়াইন (২০০০) এবং লাইফ অ্যান্ড ডেথ আর উইয়ারিং মি আউট (২০০৮) প্রভৃতি ।

শান্তি : ঐক্যের মাধ্যমে শান্তি আনার চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপকে এক করার ক্ষেত্রে ইইউর ঐতিহাসিক ভূমিকা ও ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরো জোনকে উদ্ধারে নেতৃত্ব দেওয়ার কৃতিত্বের কারণে এবারের শান্তি পুরস্কার পেয়েছে ইইউ। কাউন্সিল অব ইউরোপ সেক্রেটারি জেনারেল থর্বজেরন জাগল্যান্ডের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি প্যানেল শান্তিতে এবারের নোবেল বিজয়ী নির্বাচিত করেছে। নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউরোপে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ে গত ছয় দশকের অবদানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। পুরস্কারের সপক্ষে যেসব কারণ বিবেচনায় রাখা হয় তার মধ্যে আছে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ইউরোপে শান্তি স্থাপন, চিরশত্রুত্রয় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি একীভূত করা, বলকান যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সাবেক যুগোসভিয়ান দেশগুলোকে গণতন্ত্রের পথে আনা, স্পেন-পর্তুগাল ও গ্রিসে একনায়কতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ইত্যাদি। এর পাশাপাশি যেসব বিষয় বলিষ্ঠভাবে মোকাবিলার জন্য এই পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করা, মধ্যপ্রাচ্যসহ সিরিয়া ও আংশিক আফ্রিকায় চলমান বিবাদগুলোতে শান্তির দূত হিসেবে কাজ করা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নবরূপে আবির্ভূত আল্ট্রা ন্যাশনালিজম ও বর্ণবাদ প্রতিহত করা, সর্বোপরি বিশ্বশান্তি স্থাপনে ইউরোপী ইউনিয়নকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা প্রভৃতি।

অর্থনীতি : এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অলভিন ই রোথ ও লয়েড শ্যাপলে। দি রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স ‘স্থিতিশীল বরাদ্দ ও বাজার ব্যবস্থাপনার চর্চাতত্ত্ব’-এর জন্য মার্কিন দুই অধ্যাপককে এ সম্মানে ভূষিত করে। রোথ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং শাপলি লস অ্যাঞ্জেলেসে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক। শ্যাপলে ‘কো-অপারেটিভ গেম থিওরি’ ব্যবহার করে দুপক্ষের মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে সংযোগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কোনো পদ্ধতির বিশেষায়িত নকশা কীভাবে বাজারের দুপক্ষকেই উপকৃত করতে পারে। শ্যাপলের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রোথ ব্যবহারিকভাবে দেখিয়েছেন কীভাবে স্থিতিশীলতা বাজারের নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের ওপর প্রভাব রাখে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: আরিফুল ইসলাম আরমান, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।