ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

যেভাবে জন্ম আমার বাংলা ভাষার

আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১২
যেভাবে জন্ম আমার বাংলা ভাষার

ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা বাংলা ভাষায় কথা বলো। লেখো বাংলা ভাষায়।

কিন্তু কখনো কি ভেবেছ এ ভাষার জন্ম কীভাবে হলো? কী তার পরিচয়? মানুষ, ফুল, পাখি, গাছের মতো ভাষার জন্ম হয় কিনা? ভাবনি তো!

তাহলে এসো। একবার জেনে নেওয়া যাক। গাছের বীজ থেকে যেমন চারা গজায়, ভাষার জন্ম কিন্তু সেভাবে নয়। ভাষা তরুর মতো যেমন জন্ম নেয়নি, আবার আসেনি কল্পিত স্বর্গ থেকেও। আমাদের মধুর বাংলা ভাষা একহাজার বছর আগে এমন ছিল না। আবার এখন যেমন আছে, এমন থাকবে না একহাজার বছর পরেও। এটা ভাষার ধর্ম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া।

ভাষা বদলে যায় মানুষের মুখে মুখে। বদলে যায় শব্দের রূপ, বদল হয় অর্থ। বাংলা ভাষার আগেও এদেশে ভাষা ছিলো। আর সে ভাষা বদলেই আজকের বাংলা ভাষা।

আজ থেকে একশো বিশ বছর আগেও স্পষ্ট ধারণা ছিলোনা আমাদের বাংলা ভাষা নিয়ে। কেউ জানতো না এ ভাষার বয়স কত। তখন কেউ বলতো বাঙ্গালা ভাষা, কেউ বলতো প্রাকৃত ভাষা। আবার কেউ বলতো গৌড়ীয় ভাষা।

তোমরা কী সংস্কৃত ভাষার নাম শুনেছো? এ ভাষার অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হয়। অনেকে মনে করতেন সংস্কৃতই বাংলা ভাষার জননী। বাংলা সংস্কৃতের মেয়ে। তবে দুষ্টু মেয়ে, যে মায়ের কথা মতো চলেনি। তাই হয়ে গেছে আলাদা। অর্থাৎ তারা বলতে চেয়েছেন, সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়নি। জন্ম হয়েছে প্রাকৃত নামক আরেকটি ভাষা থেকে।

এখন যেমন তোমরা লেখো, তেমন সংস্কৃত ছিলো শুধু লেখার ভাষা। আর কথা বলার ভাষা ছিলো প্রাকৃত। প্রাকৃত ভাষার আবার কয়েকটি ভাগ ছিলো। আইরিশ অর্থাৎ আয়ারল্যান্ডের ভাষাবিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন প্রথম জানান যে অনেক প্রাকৃত ভাষার মধ্যে মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। তিনি আমাদের দেশে ছিলেন ভাষা নিয়ে গবেষণা করার জন্য।

আমাদের দেশের বিখ্যাত পণ্ডিত ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষার বিস্তৃত ইতিহাস আমাদের জানান। সে ইতিহাসটা নিশ্চয় তোমাদের জানতে ইচ্ছে করছে। তবে চলো। আমরা একটু ঘুরে আসি প্রাচীন কাল থেকে।

তোমরা নিশ্চয় জানো, বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ। ইউরোপ নামে আরো একটি মহাদেশ আছে। এই এশিয়া এবং ইউরোপের বেশ কিছু ভাষার ধ্বনিতে এবং শব্দে অনেক মিল ছিলো, এখনো আছে। ভাষাবিজ্ঞানী অর্থাৎ ভাষা বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞরা মনে করেন, এ ভাষাগুলোর একটি বংশ আছে। তার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় বংশ। ভারত এবং ইউরোপের মিলিত ভাষাবংশ। এ ভাষাগুলোকে একসময় বলা হতো আর্যভাষা। এর আবার অনেকগুলো শাখা রয়েছে। তার একটি প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। এ ভাষা লিখিত হয়েছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মের একহাজার বছর আগে; অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এর নাম তোমরা শুনেছ? বেদ এই ভাষায় লেখা। কিন্তু কঠিন ভাষা হওয়ায় ব্যাকরণবিদ অর্থাৎ যারা ভাষার ব্যাকরণ লেখায় পণ্ডিত তারা বেদের ভাষা বা বৈদিক ভাষাকে পরিমার্জন করে আবিষ্কার করলেন সংস্কৃত ভাষা। যা ছিলো তুলনামূলক সহজ। সেটা কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের কথা।

কিন্তু সে ভাষায় যদি আজ তোমারা কথা বলো, তবে মনে হবে তোমরা ভিন্ন গ্রহের মানুষ।

মানুষ তো সবসময় নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পছন্দ করে। চেষ্টা করে সবকিছু সহজ করার। আমরা যে প্রাকৃত ভাষার কথা বলেছিলাম, সে প্রাকৃত ভাষাগুলোর সর্বশেষ স্তরের নাম অপভ্রংশ অর্থাৎ যা খুব বিকৃত হয়ে গেছে। বন্ধুরা মিলে মজা করতে করতে যেমন তোমরা অনেক সময় নতুন কিছু সৃষ্টি করে ফেলো, তেমনি বলা যায়, প্রাকৃত ভাষাকে বিকৃত অর্থাৎ দুষ্টমি করে খারাপভাবে বলতে বলতে শুনতে ভালো লাগে, লিখতে ভালো লাগে, সহজ মনে হয় এমন কিছু ভাষা তৈরি হয়ে যায়। যেমন, বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি ইত্যাদি। তাই বলে তোমরা আবার বাংলা ভাষাকে খারাপভাবে বলো না। আমাদের ভাষাটি কিন্তু সত্যি অনেক মধুর।

সুনীতিকুমার এবং গ্রিয়ারসনের মতে অপভ্রংশগুলোর মধ্যে পূর্ব-মাগধী অপভ্রংশ থেকে জন্ম আমাদের বাংলা ভাষার। আমাদের দেশের আরেকজন বিখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। কিন্তু এ মতটির চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় সুনীতিকুমারে মতকে।

এভাবেই জন্ম নিলো তোমার ভাষা, আমার ভাষা, আমাদের সবার ভাষা, বাংলা ভাষা।
তথ্যসূত্র: কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী, হুমায়ুন আজাদ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।