মেক্সিকোতে সূর্যের প্রচণ্ড তাপের মধ্যে বাস করে একটি ক্ষুদ্র জীব, নাম তার গিরগিটি। দেখতে একটি সাধারণ টিকটিকির মতো এবং তার চামড়া সবুজ আর সোনালি রঙে রাঙানো।
কিন্তু এই গিরগিটি সম্পর্কে এমন একটা গল্প আছে যার জন্য এই গিরগিটি প্রজাতিটি অন্য সাধারণ টিকটিকি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই গিরগিটিরা তাদের পিঠ থেকে মাথা পর্যন্ত একটা ফাঁকা ঝুঁটি বহন করে। যখন তাদের দৌড়ানোর প্রয়োজন হয় তখন তারা তাদের ওই শূন্য ঝুঁটিটাকে বাতাসের মাধ্যমে ফোলায়, যার ফলে খুব জোরে দৌড় দিতে পারে। তাই এই গিরগিটিগুলো তাদের এই ঝুঁটিটার জন্য নিজেদের নিয়ে সবসময় গর্ববোধ করে।
আমরা এখন জানব কীভাবে তারা পিঠ থেকে মাথা পর্যন্ত এই ঝুঁটিটা লাভ করল এবং সাধারণ প্রজাতির টিকটিকি থেকে অনেক দ্রুতগামী গিরগিটিতে পরিণত হলো।
অনেককাল আগের কথা, দেবতারা মেক্সিকোকে শাসন করত। তারা ছিল সেইসব দেবতা যারা শস্যতেকে উর্বর করত, বাতাস ও বৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করত এবং পশু-পাখিকে সুরা দিত। এদের মধ্যে কিছু দেবতা ছিল যারা টগবগে ঘোড়ার মতো চলন্ত বাতাস, মেঘ ও বৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করত, দ্রুতগতির ঘোড়ার মতো মেঘমালাকে নিয়ন্ত্রণ করে পাত্রের মধ্যে রেখে দিত আর প্রয়োজনে সে মেঘমালা থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি ঝরাত। তাদের নাম কেলাবাস। আর যেসব দেবতা পশু ও পাখিদের সুরা দান করত তাদের বলা হতো কুইল-কাক্সাস। কুইল-কাক্সাসের অর্থ হলো বনের রাজা বা অধিপতি।
কুইল-কাক্সাসরা চলাফেরা করত ঘন সবুজ বনের ভেতরে দিয়ে ইউক্যালিপটাস গাছ ও কলাগাছের মতো দেখতে তালগাছের নিচ দিয়ে। তাদের সাদা চুল ও কোঁচকানো চোখ দেখে ছোট আকৃতির বৃদ্ধ লোকদের মতো মনে হতো। তারা মাথায় তালপাতা দিয়ে তৈরি একধরনের টুপি পরত।
একদিন বনের রাজাদের মধ্যে এক রাজা সব পশু-পাখিকে ডাকলেন তাদের সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্য। সবকিছু জানার পর তাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য একটা দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। এবং বললেন, ‘আমি দেখতে চাই এই পশু-পাখিদের মধ্যে কে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে দৌড়াতে পারে। ’ তিনি আরও বললেন, ‘এই দৌড় প্রতিযোগিতায় সবার আগে যে ঐ জোকারান্ডা গাছের নিচে পৌঁছতে পারবে আমি তাকে একটা পুরস্কার দেব। ’
যেসব পশু-পাখি নীরবে তার কথা শুনল তারা হলো : নেকড়ে, শেয়াল, হরিণ, বনমোরগ, খরগোশ, কচ্ছপ, কুমির, ব্যাঙ, কটকটে ব্যাঙ (স্থলব্যাঙ), আঁশওয়ালা ইগুয়ানা। আরও ছিল গাছের ডালে থাকা লালঠুঁটো পায়রা, তোতাপাখি, চমৎকার কোইয়েটজাল পাখি ও বাচাল টাচকানসহ আশপাশে থাকা আরও অনেক জীবজন্তু।
সবাই চুপ করে থাকার পর হঠাৎ একটা শেয়াল বলে উঠল আমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হবে যেখানে হরিণের মতো প্রাণী প্রতিযোগিতা করবে? যে পারে সে হবে এই বনের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির প্রাণী। হরিণের তুলনায় কীভাবে আমরা একটা কচ্ছপের বেশি আশা করতে পারি?
খরগোশ এবং অন্য প্রাণীরা শেয়ালের সঙ্গে একমত প্রকাশ করল, আর এই ফাঁকে তোতাপাখি উপহাসের হাসিতে ফেটে পড়ল এই বলে যে ‘বুকে হেঁটে চলা কচ্ছপ প্রতিযোগিতা করবে দ্রুতপায়ের হরিণের সঙ্গে!’
‘আমি যা বলছি সবাই কি এর সঙ্গে একমত? শেয়াল বলল। একটা প্রাণী ‘না’ বলে উঠল। আসলে সে শেয়ালের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। আর সে প্রাণীটিই হলো গিরগিটি।
‘পুরস্কারটা কী?’গিরগিটিটা বনের রাজার কাছে জানতে চাইল। তার কথা শুনে বনের অন্য প্রাণীরা অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল। এ কারণে তাকাল যে গিরগিটির মতো এত ক্ষুদ্র জীব বনের রাজাকে কীভাবে প্রশ্ন করতে সাহস পেল! তোমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ওই সময় গিরগিটিরা দেখতে অন্য সাধারণ টিকটিকির চেয়ে মোটেও ভিন্ন ছিল না।
কিন্তু বনের রাজা এই গিরগিটির কথা শুনে হাসলেন এবং তাকে বললেন, ‘যদি তুমি দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়ী হও, ছোট গিরগিটি, আমি তোমার মাথায় কোণওয়ালা একটা বড় টুপি পরিয়ে দেব; যাতে প্রত্যেকে তোমার সম্পর্কে জানতে পারে যে তুমি দ্রুত পায়ের হরিণের বিপে দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছো। ’
তখনই বনের জীবজন্তুরা আবারও উপহাসের হাসিতে ফেটে পড়ল। কিন্তু ছোট গিরগিটি ধীরকণ্ঠে বলল, ‘আমি ওই কোণওয়ালা টুপিটাকে জয় করবই! আমি হরিণের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করে তার আগেই ঐ জোকারান্ডা গাছের নিচে পৌঁছবো। ’
তারপর বনের রাজা গিরগিটি আর হরিণকে বললেন দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করার জন্য এক লাইনে দাঁড়াতে। ‘আমার একটা শর্ত আছে গিরগিটি বলল। ‘যখন আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করব তখন প্রত্যেকের চোখ বন্ধ রাখতে হবে। ’
তার শর্তমতো বনের রাজা সবাইকে চোখ বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন যতণ না তিনি এক... দুই... তিন পর্যন্ত গণনা করবেন। দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তারপর অন্য প্রাণীরা চোখ খুলে দেখতে পেল হরিণ দৌড়ে যাওয়ার কারণে সূর্যের আলোর সঙ্গে ধুলাবালি মিশে ধূলিমেঘের সৃষ্টি হয়েছে।
এখন হরিণ সবচেয়ে দ্রুতগতিতে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ সে চিন্তা করল, ‘কেন আমি এত তাড়াহুড়ো করছি? আমি যখন দৌড় শুরু করেছি আমার প্রথম লাথিতেই হয়ত হীন ুদ্র গিরগিটিটা বালির নিচে চাপা পড়েছে। এতণে মনে হয় মারাই গেছে। ’ তাই হরিণটা তার গতি কমিয়ে একেবারে সাধারণভাবে পা ফেলতে লাগল এবং প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় অর্ধেক সময়টা এভাবে গা-ছাড়া ভাবেই প্রতিযোগিতা শেষ করল।
বনের রাজা, যিনি চাইলে অবশ্যই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যে কোনো দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতেন। তিনি জোকারান্ডা গাছের নিচে অপো করতে লাগলেন কখন হরিণ এসে পৌঁছবে। অবশেষে হরিণ গাছের নিচে এসে পৌঁছল। হঠাৎ কী যেন একটা সূর্যের আলোর মধ্যে জ্বলজ্বল করতে দেখে হরিণটা সেদিকে তাকাল। কিন্তু এ কী! সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ যে সেই গিরগিটিটা! এটা কী করে সম্ভব, এই ক্ষুদ্র গিরগিটি কীভাবে তার আগে এখানে এসে পৌঁছল!
‘এই গিরগিটিটা এখানে এসে পৌঁছেছে তুমি আসার অনেক আগেই’, বনের রাজা হরিণকে বললেন। ‘সে দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে এবং আমি তাকে পুরস্কৃত করব যা তাকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলাম। ’
যখন অন্যসব প্রাণী জোকারান্ডা গাছের নিচে এসে পৌঁছল তারা সবাই বিস্মিত, যেমনটা হরিণ হয়েছিল। তোতাপাখি উপহাস করতে ভুলে গেল, এমনকি প্রতারক শেয়ালটা পর্যন্ত নীরব রইল।
বনের অধিপতি ছোট গিরগিটিকে তার উপহার কোণওয়ালা টুপিটা পরিয়ে দিলেন। এটা অনেক বড় কোণওয়ালা টুপি, যা পরিয়ে দেওয়ার ফলে গিরগিটিটার পিঠ থেকে মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল।
‘তুমি খুব চালাক হে ক্ষুদ্র জীব’, বনের রাজা গিরগিটিকে বললেন।
তিনি এবং গিরগিটিটা একটা মুচকি হাসি বিনিময় করল। হাসিটা এজন্য যে, শুধু বনের রাজাই জানেন কীভাবে গিরগিটিটা এই উপহারটা পেল। দৌড় প্রতিযোগিতা শুরুর সময় সবাই যখন চোখ বন্ধ করল তখন গিরগিটিটা হরিণের লেজে লাফিয়ে উঠেছিল এবং যতণ পর্যন্ত হরিণটা দ্রুততার সঙ্গে দৌড় দিয়েছিল ঠিক ততণ গিরগিটিটা তার লেজে আটকে ছিল। কিন্তু হরিণটা যখন তার গতি কমিয়ে দিল সে সময় গিরগিটিটা চালাকি করে হরিণের লেজ থেকে নেমে ছোট ছোট পায়ে অনেক জোরে দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে হরিণের আগেই সে জোকারান্ডা গাছের নিচে এসে পৌঁছল।
এভাবেই গিরগিটি তার পিঠ থেকে মাথা পর্যন্ত ঝুঁটি লাভ করল, এটা এজন্যই দেওয়া হয়েছিল যাতে করে প্রত্যেকে সবসময় জানতে পারে যে এই গিরগিটিই একদিন দ্রুতগতির হরিণের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করে জয়ী হয়েছিল।
(মেক্সিকোর রূপকথা)