মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে রিশি। বৃষ্টির ফোঁটায় জানালার কাচ ভিজে গেছে।
বৃষ্টি এখন বেড়ে গেছে। রোদটা এখন আর নেই। তার অর্থ হল খেঁকশিয়ালের বিয়ের আয়োজন শেষ। বাসটা আরো জোরে চলছে। রিশি খুব ব্যগ্র হয়ে আছে। কখন যে পৌঁছুবে নানুবাড়ি! ক্লাস থ্রিতে পড়ে রিশি। সামনে পরীক্ষা। মাত্র ১৫দিন পর। পরীক্ষার আগে আগে গ্রীষ্মের ছুটি। এই সময়টায় কেউ বেড়াতে যাবে না। সবাই পড়বে। রিশি সেকথা জানে। কিন্তু ও নানুবাসায় না গেলে পড়তে পারবে না। আর এই গ্রীষ্মের সময়টায় তো কথাই নেই। নানুবাড়ির গাছে আম-কাঁঠাল-লিচু-জামরুল কত কী ধরেছে! ওগুলি না খেলে রিশির মন ভরবে না।
একটু আগেই রিশিরা নানুবাড়িতে পৌঁছেছে। বৃষ্টি হচ্ছে এখানে অনেক। বৃষ্টিতে বাইরে বেরুনো দায়। তবুও রিশি একটা বিশাল বড় কালো ছাতা নিয়ে বাইরে বের হলো। কোন গাছে কী ধরেছে না দেখলে চলবে কী করে?
হুম। যা ভেবেছিল রিশি। ওর নানুবাড়িতে অনেক রকম আম গাছ আছে। আম্রপালি, মোহনভোগ, কোহিতুর, ফজলি, হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, গোলাপখাস, সূর্যমুখী, কালিভোগ, আশ্বিনী আম- কোন জাতের চারা তার সেজ মামা লাগায়নি! সেজ মামার কাজ হলো সব সুন্দর ফুলগাছগুলি কেটে আমের চারা লাগানো। এটা অবশ্য রিশির ভাল্লাগে না। এটা নিয়ে সে কত চেঁচামেচি করে! কিন্তু জৈষ্ঠ্য মাস আসতেই রিশি সেজ মামার পক্ষে চলে যায়। সত্যিই তো! কী হত ফুলগাছের জঙ্গল বানিয়ে। তার চেয়ে বরং ফলের গাছ লাগিয়ে ফল খাওয়াই তো বেশি মজা। আর ফুলগাছগুলিকে এভাবে জংলাভাবে না লাগিয়ে সেজমামার মতো সুন্দর করে সারিবদ্ধভাবে গুছিয়ে লাগানোই ঠিক। তাহলে সেগুলিও দেখতে সুন্দর হয়।
এবার নানুবাসার সবগুলি গাছে আম ধরেছে। তবে রিশির প্রিয় কালিভোগ আমটা ধরেছে কম। এতে রিশির খুব বেশি আফসোস হচ্ছে না। অন্য আমগাছগুলো আফসোস পুষিয়ে দিয়েছে। একেকটা গাছ একদম ঝুঁকে গিয়েছে আমের ভারে। লিচু গাছে লিচু এবার বেশি ধরেনি, কিন্তু নেহায়েতই কমও না। পাখিগুলো তো রিশি আসার আগেই কতগুলো লিচু সাবাড় করে ফেলেছে। জামরুলগুলো এখনো পাকেনি, কিন্তু বড় হয়েছে। কয়েকটা আধপাকা হয়ে আছে। কোনোটা আবার আধখাওয়া। কাঁঠালগাছে সাতটা কাঁঠাল ধরেছে। একদম লাইন ধরে। কী মজার কথা!
রিশি বাগানের কোণায় করমচা গাছটার কাছে গিয়ে দেখল ওটা ফলে ফলে ভরপুর হয়ে আছে। দেখলেই জিভে জল এসে যায়। কতগুলি করমচা পেকে লাল টুসটুসে হয়ে আছে। রিশি একটা করমচা ছিঁড়ে নিল। অমনি কস পড়ে ওর মেখে গেল হাত। টুক করে সে ওটাতে একটা বসালো কামড়। ও বাবা! কী টক! রিশির অবশ্য করমচা দেখে একটা ছড়া মনে পড়ে গেল-
লেবুর পাতায় করমচা-
যা বৃষ্টি ধরে যা।
জৈষ্ঠ্য মাসে অনেক রকম ফল ধরে বলে এই মাসকে বলে মধুমাস। মায়ের কাছে রিশি এ কথা শুনেছে। এবার বুঝলো কথাটা কত ঠিক।
নানুবাসার গাছগুলোতে শুধু ফল ধরেই ক্ষান্ত হয়নি, ফুলগাছগুলিও অনেক রকম ফুল ফুটিয়েছে। নয়তো ওদের দিকে কেউ তাকাবে না। তখন ওদের মন খারাপ হয়ে যাবে। ফুলবাগানে দোলনচাঁপা গাছে সাদা রঙের সুন্দর দোলনচাঁপা ফুটেছে। কী মিষ্টি তার ঘ্রাণ! বাসার সামনের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটাতে তো কোনো পাতাই দেখা যাচ্ছে না। রাঙা রাজকন্যার মতো ছড়াচ্ছে শোভা। কৃষ্ণচূড়া বসন্তের ফুল হলেও এখনো গাছটা রক্ত লাল ফুলের সাজে সেজে আছে। আর বাড়ির পেছনের বকুল গাছটার কাছে যেতেই রিশির মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। অনেক দূর থেকেই বকুল ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। রিশি গিয়ে দেখে গাছতলাটা বিছিয়ে আছে ফুলে। বৃষ্টি হওয়ার কারণে কাদা হয়ে গিয়েছে। রিশি তাই আর ফুল কুড়াতে পারলো না।
রিশি ছাতাটা ভালো করে আঁকড়ে ধরে খাল পাড়ের ল্যাংড়া আমগাছের দিকে এগুলো। গাছতলাটা একদম জঙ্গল হয়ে আছে। কচুগাছ, ঘাস-পাতায় গাছতলা গেছে ঢেকে। মেজমামার উপর খুব রাগ হয় রিশির। মেজমামা তো জানত সে আসবে। তার আগে সব পরিষ্কার করে রাখবে না? নয়তো কীভাবে আম কুড়োবে ও?
ঘাস-পাতার মধ্যে দিয়েই পা বাড়ায় রিশি। কিছুক্ষণ কষ্ট করে এগুনোর পর পায়ের কাছে কী যেন একটা বাধে। রিশি ভয় পেয়ে যায়। কোনো পোকামাকড়-জীবজন্তু না তো? পায়ের দিকে তাকিয়ে শুধু লতাপাতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না সে। এবার সেই লতাপাতাগুলো হাত দিয়ে সরায় ও। ওমা! এটা কী? এ যে একটা টুসটুসে পাকা আম! খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে রিশি। আমটাকে এক হাতে তুলে নিয়ে অন্য হাতে ছাতাটাকে ভালো করে ধরে কাদামাটি ভেঙে দৌড় দেয় ও। নানুকে আর মাকে দেখাবে। তারপর নানুকে বলবে আমটাকে কেটে দিতে।
রিশি নানুর কাছে যাওয়ার আগেই নানু ওকে ডাকতে শুরু করলেন। রিশি ততক্ষণে হাতে-পায়ে কাদামাটি মেখে নানুর কাছে রান্নাঘরে হাজির হয়েছে। নানু ওকে দেখে হেসে ফেললেন।
-এটা কী করেছ রিশিমণি? হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন নানু।
-আরে নানু! দেখো! আমি একটা বড় পাকা আম পেয়েছি। তুমি কেটে দাও। রিশি নানুর কথা অগ্রাহ্য করে আমটাকে দেখালো।
-সে তো বুঝলাম। কিন্তু এই আমটাতো মিষ্টি হবে না। এটা তো পুরোপুরি পাকেনি। বৃষ্টির সময় বাতাসে পড়ে গিয়েছে।
নানুর কথা শুনে রিশি খুবই হতাশ হলো। এত কষ্টে ঝোপ-ঝাড় ভেঙে একটা আম খুঁজে পেল আর সেটা নাকি এখনো পাকেনি! রিশির মন খারাপ দেখেই কিনা নানু বললেন, রিশি, তুমি আসার আগেই আমি কিছু পাকা আম পাড়িয়ে রেখেছি। সেগুলো কেটে দিচ্ছি। তুমি খাও।
রিশির মুখটা আবার ঝলমল করে উঠলো। নানু বেশ কিছু পাকা আম কেটে একটা বাটিতে করে ওর হাতে দিলেন। একটা আম মুখে দিয়ে রিশি আনন্দে হাততালি দিয়ে ফেলল। এত্ত মজার আম! কী মিষ্টি!
পরদিন সকালেও বৃষ্টি চলতেই থাকলো। থামাথামির কোনো নাম নেই। নানু রিশিকে পুরনো টিনের ঘরটায় নিয়ে এলেন। এখানে এখন কেউ থাকে না। রিশি খাটে উঠে বসলো। মনে হচ্ছে যেন কেউ নূপুর পরে বৃষ্টির ছন্দে নেচে চলেছে। কী মজার কথা! টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ এত সুন্দর! রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যায় রিশি।
বিকেলে বৃষ্টি ধরে এলে মেজমামা রিশিকে সাইকেলে চেপে বেড়াতে নিয়ে গেলেন। সারাপথ রিশি এদিক-ওদিক তাকিয়ে অবাক দৃষ্টিতে সব দেখতে দেখতে গেল। আজকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছে ও। বেশিরভাগ মানুষ কোথাও যাওয়ার সময় লিচু নিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টায় মানুষ কারো বাসায় যেতে হলে লিচু নিয়ে যায়। এর কিছুদিন আগে চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের শুরু পর্যন্ত নেয় তরমুজ। আর জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি থেকে নিতে শুরু করে আম আর জাম। জৈষ্ঠ্য মাসটা যখন যাব যাব করে টা-টা বাই বাই দেয়া শুরু করে তখন মানুষ কেনে কাঁঠাল।
রিশি এতসব ভাবতে ভাবতে মেজমামা সাইকেলটাকে একটা ক্ষেতের পাশে দাঁড় করালেন। রিশিকে হাত ধরে নিয়ে এলেন ক্ষেতের ভেতর। কী অবাক করা ব্যাপার! ক্ষেতের মধ্যে ইয়া বড় বড় বাঙ্গি! মেজমামা রিশিকে বললেন, রিশি, এটা হল বাঙ্গি ক্ষেত। জৈষ্ঠ্য মাস কিন্তু শুধু আম-কাঁঠালের সময় না, বাঙ্গিও জৈষ্ঠ্যের ফল।
রিশি মজা করে ক্ষেতটা ঘুরে দেখল। তারপর মেজমামা ওখান থেকে তিনটা বড় বড় বাঙ্গি কিনে নিলেন। ফেরার পথে তালের শ্বাস কিনে রিশিকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন মেজমামা।
দেখতে দেখতে কীভাবে যেন ছুটির দিনগুলি ফুরিয়ে গেল। হয়ে গেল যাওয়ার সময়। মা রিশিকে বললেন সবকিছু গুছিয়ে নিতে। ওর খুব মন খারাপ হলো। ভারি তো পরীক্ষা! স্কুল এত পচা কেন? কেন মিসদেরও কী আম-কাঁঠাল খেতে মন চায় না? এই সময়টায় কেন পরীক্ষা দেন তাঁরা? পরীক্ষার উপরও রিশির খুব রাগ হয়। কেন বাবা? পরীক্ষার কী নানুবাসা নেই? সেও যাক না তার নানুবাসায়। গিয়ে আম-জাম খাক। এই জৈষ্ঠ্য মাসের সময়টায় তার আসার দরকার আছে?
রিশিদের বাসটা ছেড়ে দিচ্ছে। রিশি জানালা দিয়ে মাথা বের করে পেছন দিকে তাকায়। এখান থেকে তার নানুবাসা দেখতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু রিশি বাতাসে নানুবাসার আমগাছের দুলে ওঠার শব্দ পায়। মেঘের ভেলায় দেখতে পায় নানুবাসার প্রতিচ্ছবি।
সবাই এমন কেন? রিশি বুঝতে পারে না। কেন পরীক্ষা আগে হয়ে গেল না? এখনি কেন হতে হবে? কেন সে আর কিছুদিন নানুবাসায় থেকে ফলমূল খেতে পারবে না? গাছ থেকে জামরুল আর লিচু ছিঁড়তে পারবে না? ঝড়ের পর আমতলায় গিয়ে আম কুড়াতে পারবে না? রিশির খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। খুব। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com