ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

দুখু মিয়া থেকে নজরুল

মীম নোশিন নাওয়াল খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৩
দুখু মিয়া থেকে নজরুল

প্রজাপতি, প্রজাপতি,
কোথায় পেলে ভাই অমন রঙিন পাখা?
ওই লাল-নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা।

কী? পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চই তুমি ভাবছো, আরে! এটা তো সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি।


হ্যাঁ। সেকথা ঠিক। এটা তোমার জানা একটা ছড়াগান। কিন্তু এটা কে লিখেছেন তা কী জানো?
এটা লিখেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। জানোই তো, তিনি আমাদের জাতীয় কবি। ছোটোবেলা থেকেই নজরুল খুব প্রতিভাধর ছিলেন। কিন্তু জানো কী, তার জীবনটা কত কষ্টের ছিল? জীবনে অনেক কষ্ট করে নিজেকে এত উঁচু পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন নজরুল।

m32কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে ( ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ। মা জায়েদা খাতুন। খুব ছোটবেলায় নজরুলের বাবা-মা মারা যান। তারপর শুরু হয় দারিদ্র্য এবং অন্যসব প্রতিকূলতার সঙ্গে তার লড়াই। ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল বলে নজরুলের ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’।

গ্রামের মক্তব থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন নজরুল। মাত্র বারো বছর বয়সে যোগ দেন গ্রামের লেটো গানের দলে। গ্রামের মক্তবেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন তিনি। তারপর আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ নেন। সেখানে এক বাঙালি পুলিশ অফিসারের নজরে পড়ে যান তিনি। সেই অফিসার তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর হাবিলদার হিসেবে যোগদান করেন। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

এবার বুঝলে তো কেন তাঁর ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া?
নজরুল কিন্তু এর মধ্যেও তার প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। সাংবাদিক হিসেবেও দেখিয়েছেন কৃতিত্ব। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে নবযুগ, লাঙ্গল ও ধূমকেতু পত্রিকা। নজরুলের প্রকাশিত প্রথম কবিতা ছিল ‘মুক্তি’। কিন্তু তাকে খ্যাতি এনে দেয় ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতা। এ কবিতার কারণে পরবর্তীতে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।   ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি রচনা করে নজরুল ব্রিটিশ শাসকদের ব্যঙ্গ করেছিলেন। এ কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়।

তবুও লেখালেখি ছাড়েননি নজরুল। একের পর এক কালজয়ী সব লেখা সৃষ্টি করেছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বাকশক্তি হারান। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়।

এতক্ষণ তো নজরুলের জীবন জানলে। এবার ভেবে দেখো তো, নজরুল তার জীবনে কত কষ্ট করেছেন? এ থেকে কিন্তু তোমাদেরও শেখার আছে। নজরুলের জীবন থেকে সব প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাই আমরা।

নজরুল কিন্তু শুধু বড়দের জন্য লেখেননি, ভেবেছেন ছোটদের কথাও। ছোটদের জন্য তার লেখাগুলো আজও তোমাদের মতো শিশু-কিশোররা পড়ে মুগ্ধ হয়। m22

থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে,
দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

কী সুন্দর একটা লেখা, তাই না? এটাও কিন্তু নজরুলেরই লেখা। লেখাটার নাম ‘সংকল্প’।
আমি হব সকাল বেলার পাখি,
সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।
সূর্যিমামা ওঠার আগে উঠব আমি জেগে,
হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন,
মা বলবেন রেগে।

এটা নজরুলের আরেকটা শিশুতোষ কবিতা। কবিতার নাম ‘আমি হব’। কী মজার একটা কবিতা না?
কী? নজরুলের আরো লেখা পড়তে ইচ্ছে করছে তো? তাহলে এবার তোমাদের জন্য নজরুলের লেখাগুলোর মধ্যে কয়েকটার কথা বলি।

নজরুল শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক লিখেছেন। তার লেখা শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ঝিঙেফুল, সঞ্চয়ন, পিলে পটকা, ঘুম জাগানো পাখি, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এবং ছোটদের জন্য নাটকের মধ্যে আছে ‘পুতুলের বিয়ে’।

লেখাগুলোর নামও খুব সুন্দর তাই না? তুমি যদি এগুলো পড়তে চাও, তাহলে চটজলদি সংগ্রহ করে ফেলো।    
নজরুলের লেখা গান কিন্তু বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। গানটি এরকম:
চল চল চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণীতল
অরুণপ্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল।

খুব উৎসাহব্যঞ্জক একটি গান, তাই না?
নজরুল কিন্তু নানা ধর্মের ধর্মীয় বিষয় এবং অনুষ্ঠানাদি নিয়েও লিখেছেন।

ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
ওরে আপনাকে আজ বিলিয়ে দে তুই আসমানী তাগিদ।

m120ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ-উল-ফিতরের উপর লেখা নজরুলের এই গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এরপর অনেক গান লেখা হলেও আজও ঈদের উপর লেখা এই গানটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়। লিখেছেন হিন্দুধর্মের জন্য শ্যামাসঙ্গীতও।

শুধু তাই না, নজরুল নিজে গান গাইতেন। লিখেছেন তিন হাজারের বেশি গান। করেছেন অভিনয়ও। গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধেও ছিল মুন্সিয়ানা।

নজরুল তার সাহিত্য কর্মের জন্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ উপাধি দেয়। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ডি. লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।

তাহলে? কী বুঝলে? শুধু নিজের প্রচেষ্টায় আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য স্থানে, এক অন্যরকম উচ্চতায়। তিনি একজন সফল সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে। তাই আজও মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। নজরুল যুগ যুগ ধরে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।


বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৩ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।