ফাল্গুনমাধুরী তার চরণের মঞ্জীরে মঞ্জীরে
নীলমণিমঞ্জরির গুঞ্জন বাজায়ে দিল কি রে।
আকাশ যে মৌনভার
বহিতে পারে না আর,
নীলিমাবন্যায় শূন্যে উচ্ছলে অনন্ত ব্যাকুলতা,
তারি ধারা পুষ্পপাত্রে ভরি নীল নীলমণি লতা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে এভাবেই ধরা দিয়েছে অপরূপ রূপসী ফুল নীলমণি লতা। নাম শুনলেই মনে হয় ফুলটি দেখতে না জানি কত সুন্দর! ধারণা মিথ্যে হবে না যদি নিজ চোখে দেখা যায়। সত্যিই নীলমণি লতা অত্যন্ত সুন্দর স্নিগ্ধ একটি ফুল।
শান্তিনিকেতনের উত্তরায়নের কোণে রবীন্দ্রনাথের বাড়ির আঙিনায় একটি বিদেশি চারা রোপণ করেছিলেন কবির বন্ধু পিয়ার্সন। অনেকদিন পর সে গাছকে সুসজ্জিত করে ফোটে নীলচে বেগুনি রঙের ফুল। তার নীলাভ শোভা আর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার নাম দেন নীলমণি লতা। তারপর ফুলটিকে নিয়ে লেখেন একটি গান। সেটারই খানিকটা অংশই তুলে দিয়েছি এ লেখার শুরুতে।
নীলমণি লতা খুব আকর্ষণীয় একটি ফুল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Petrea volubilis, পরিবার ভার্বেনেসি। ইংরেজি নাম Blue Bird Vine, Purple Wreath, Queen’s Wreath, Sand paper Vine । ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে আঠার শতকের বিশিষ্ট উদ্ভিদ সংগ্রাহক রবার্ট জেমস পিটারের নাম থেকে।
নীলমণি লতার কথা স্পেনের অনেক লোককাহিনী ও উপকথায় পাওয়া যায়। পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় এটি অনেক সাধু-সন্ন্যাসীদের আশ্রমেও ছিল।
নীলমণি লতা মূলত উত্তর আমেরিকার ফুল। লতানো গাছ নীলমণি লতার। শাখার অগ্রভাগে গুচ্ছাকারে ফুল ফোটে। ফুলটি তারার মতো দেখতে। পাপড়ি রয়েছে পাঁচটি। পাপড়িগুলোর নিচেই থাকে হালকা নীল রঙের পাঁচটি বৃন্ত।
প্রতিটি পুষ্পমঞ্জরিতে থাকে ১৫-৩০টি করে ফুল। পাপড়ির গোড়া একটা খাটো নলের সঙ্গে যুক্ত। ফুল ফোটার পর ঝরে যায় দ্রুত। ফুল থেকে ফল হয়। ফল হয় শক্ত, শাঁস কম। গাছ লম্বা হয় ১৩ মিটার পর্যন্ত। অনেক লতা একসঙ্গে জড়াজড়ি করে তৈরি করে ঝোপ।
নীলমণি লতা সারা বছরই ফোটে। তবে বসন্তে সবটুকু উজাড় করে মেলে ধরে নিজেকে। শীতকালে ফুলটি খানিকটা গুটিয়ে নেয় নিজেকে। শীতে তাই তার দেখা মেলে অল্পস্বল্প। মূলত মার্চ-এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত প্রকৃতিকে রূপের ছটায় সুশোভিত করে ফোটে নীলমণি লতা।
বিশ্বে ১৩০ প্রজাতির নীলমণি লতা রয়েছে। বাংলা নাম নীলমণি হলেও ফুলটি কিন্তু সাদা রঙেরও হয়। তবে বাংলাদেশে সাদা ফুলটি পাওয়া যায় না বললেই চলে। নীল রঙের ফুলটি নীলাভ হলেও বেগুনি রঙের ছোঁয়া আছে তাতে। নীল-বেগুনির মিশেলে অন্যরকম এই রঙের খেলাই ফুলটিকে এত বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে।
নীলমণির পাতা লম্বায় ৬-২১ সেন্টিমিটার এবং চওড়ায় ২-১১ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। পাতার রং হালকা সবুজ। পাতা হয় খসখসে। কখনো কখনো শিরা বরাবর ঢেউ খেলানো। পাতার আকৃতি উপবৃত্তকার। সামনের দিক আস্তে আস্তে সরু কিন্তু ভোঁতা হয়ে আসে। নীলমণি লতার বংশবিস্তার হয় কলমের মাধ্যমে। ফুলটির ঘ্রাণ আছে, তবে তা একদমই হালকা।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় একটি ফুল ছিল নীলমণি লতা। দেখতে সে সত্যিই ভারি মিষ্টি। শহুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমরা আজ আর প্রকৃতির দিকে ফিরে তাকানোর সময় পাই না। তবে নীলমণি লতার দিকে একবার তাকালে যে কেউই উপলব্ধি করতে বাধ্য, প্রকৃতির কী বিচিত্র সৌন্দর্য সম্ভার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করি আমরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, জুন, ০২, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com