ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

বাবা দিবসের গল্প

দূর আকাশের তারা

মীম নোশিন নাওয়াল খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৯ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৩
দূর আকাশের তারা

ভিসার কাগজপত্র হাতে নিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠল তুহিন। উফ! কী মজা! এতদিনের স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হতে চলেছে।

তারা আমেরিকা যাবে... আমেরিকায় থাকবে। আনন্দে মনটা ভরে ওঠে তুহিনের।

মায়ের মুখটা শুকনো দেখে তুহিন অবাক হলো। মায়েরই তো ইচ্ছে ছিল আমেরিকায় থাকার। মায়ের স্বপ্নটাই না তুহিন নিজের মধ্যে গেঁথে নিয়েছে। আজ মায়ের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আর মা কী-না...
-কী হয়েছে মা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? জিজ্ঞেস করল তুহিন।
-তোর বাবার ভিসা হয়নি। ধরা গলায় উত্তর দিলেন মা।

তুহিন কিছুক্ষণ থমকে রইল। মনের ভেতর উথাল-পাথাল চলছে। বাবাকে ফেলে চলে যেতে হবে? কোনো মানে হয়? বাবাকে ফেলে কীভাবে থাকবে সে?

এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে তুহিন, তুষার, মা আর বাবা। বাবার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল তুহিন। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না বাবা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।

ছেলের কথা শুনে মা আঁচলে চোখ মুছলেন। বাবা তুহিনের চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, দূর পাগল ছেলে! আমাকে ছাড়া কে থাকতে বলেছে তোকে? আমি দেখিস দু-তিন মাসের মধ্যেই ভিসা পেয়ে যাব। তারপর একদম উড়ে উড়ে তোর কাছে চলে যাব। এটুকু সময় কীভাবে চলে যাবে তুই টেরও পাবি না। নতুন জায়গা, গুছিয়ে উঠতেই দেখবি তিন মাস লেগে যাবে। তার মধ্যে আমার ভিসা হয়ে যাবে আর আমি চলে যাব। গিয়ে দেখব তোরা আমার জন্য সব গুছিয়ে রেখেছিস। কী ভালো হবে না?”

তুহিন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো।

-সত্যি তুমি দু-তিন মাসের মধ্যে চলে আসবে?  জিজ্ঞেস করল তুহিন।
সত্যি। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবি আমি তোর পাশে শুয়ে আছি।
তুহিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন বাবা, নে, এবার আর দেরি করিস না। চল।
নিউ ইয়র্ক পৌঁছে তুহিনের একদম মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। এত সুন্দর শহর! কী সুন্দর সব বিল্ডিং! আর ওদের রাস্তাগুলোও কী ভালো! বাংলাদেশের মতো যানজট নেই একদম। সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলে। তুহিন প্রতিটা জিনিস দেখে আর ভাবে, বাবা থাকলে বাবাকে এগুলো দেখিয়ে কত প্রশ্নই না করত সে! আর বাবাও সব প্রশ্নের উত্তর দিত খুব সুন্দর করে।

নিউ ইয়র্কে এসে তুহিনরা যে বাসাটায় উঠেছে, সেখান থেকে সামনে একটা পার্ক দেখা যায়। ওই পার্কটা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই তুহিনের। ওখানে তার বয়সী ছেলেমেয়েরা লুকোচুরি খেলে। বৃদ্ধরা বসে আড্ডা দেয় বা সংবাদপত্রে চোখ বুলায়। ওই পার্কের গাছগুলো যেন ডাকে তুহিনকে।   কতবার ওখানে যেতে চেয়েছে সে! মা যেতে দেয়নি। ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে, একা একা ছাড়া যায়? তাও আবার নতুন জায়গা। মা যতবার নিষেধ করে, তুহিন ততবার ভাবে, বাবা থাকলে সে বাবার সাথে ওখানে যেত।

বাসার সামনের গাছগুলোকে সাদা পোশাক পরাতে যখন তুষার পড়ে, যখন বাড়িগুলোর ছাদ শুভ্র সাদা হয় তুষারের স্পর্শে, তুহিন বাবাকে ফোন করে। বলে, বাবা জানো, এখানে না তুষারপাত হচ্ছে। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমার বাবা কোথায়। আমি বলেছি বাবা কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে। তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। ঠিক বলিনি বাবা?

তুহিনের প্রতিদিনের বাবাকে কাছে পাওয়ার আকুতি, বাবার ভিসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন আর ফুরাতে চায় না। আর তুষারটা তো কিছু বোঝেই না। তিন বছরের ছেলেটা কী আর বুঝবে? একদিন বাবার ফোন তুহিনের আকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটায়। বাবা ওপাশ থেকে আনন্দিত গলায় বলেন, আমার ভিসা হয়ে গেছে রে তুহিন... প্লেনের টিকেটও কেটে ফেলেছি। আমি কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবো।

তুহিনের আনন্দ আর ধরে না। আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে সে। জানালার কাছে দৌড়ে যায়। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে তুহিন বলে, হ্যাঁ রে তুষার, আমাকে জিজ্ঞেস করিস না তোরা প্রতিদিন, আমার বাবা কবে আসবে? আমার বাবা খুব দ্রুত চলে আসবে। বাবার ভিসা হয়ে গেছে তো। বাবা নিউ ইয়র্ক আসার টিকেটও কেটেছে। আমার বাবা অনেক ভালো, জানিস তো। তোদের সাথে বাবার পরিচয় করিয়ে দেব। দেখবি, বাবা কত ভালো।

ফোনের আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে যায় তুহিন। কে ফোন করেছে? বাবা? বাবা কবে আসবে? দ্রুত ফোনের কাছে ছুটে যায় সে। মা ফোনটা ধরেছে। তুহিন দেখে মায়ের চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখ বেয়ে অশ্রু নামছে। মা কোনোভাবে ফোনটাকে নামিয়ে রাখলেন। কোনো কথা বললেন না। শব্দ করলেন না। যেন পাথরের মূর্তি।

তুহিন মায়ের কাছে ছুটে গেল। মাকে ঝাঁকি দিয়ে বলল, কী হয়েছে মা? কে ফোন করেছে? বাবা? বাবা বলেছে কবে আসবে? কবে আসবে বাবা?

মা নিরুত্তাপ কণ্ঠে ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবা আর আসবে না রে তুহিন। আর আসবে না। সে যে অন্য এক জগতের ভিসা পেয়ে গেছে। সেখানেই চলে গেছে সে।

তুহিন অবাক হয়। কোথাকার ভিসা পেল বাবা? আর পেলেই বা সেখানে গেল কেন? বাবার তো এখানে আসার কথা। তার কাছে আসার কথা। তাকে ফেলে কোথায় গেল বাবা? সে জিজ্ঞেস করে, বাবা কোথাকার ভিসা পেয়েছে মা?

-ওই দূর আকাশে যাওয়ার ভিসা। দূর আকাশে তারা হয়ে থাকার ভিসা। সেই তারার দেশ থেকে আর কেউ ফিরে আসে না রে... বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা।

তুহিন অবাক হয়। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে তো অনেক তারা। কোন তারাটা বাবা? বাবার উপর খুব অভিমান হয় তার। কেন? তাকে ফেলে বাবার তারা হতে ইচ্ছে হল কেন? কেন বাবা দূর আকাশের তারা হতে গেল? এখন কীভাবে বাবাকে খুঁজে পাবে তুহিন? মনে মনে তুহিন বলে, তারার দেশের ভিসা কীভাবে পায় বাবা? বলো না। আমিও ভিসা নিয়ে তারার দেশে যাব। আমি তোমার কাছে যাব। তোমার সাথে থাকব। সন্ধ্যে হলেই আমরা দুজন মিলে মিটমিট করে জ্বলবো। বলো না বাবা, কীভাবে হতে হয় দূর আকাশের তারা?

বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি
মেইল- ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।