ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

অপেক্ষা

মীম নোশিন নাওয়াল খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১৩
অপেক্ষা

নাহ। পলার মনটা মোটেই ভালো নেই।

দুদিন বাদে ঈদ। অথচ বাবা এখনো বাড়ি আসেনি। তার জন্য নতুন জামা নিয়ে আসার কথা বাবার। প্রতি ঈদে তাই তো করে। আর এবার নাকী বাড়ি ফেরারই নাম নেই। পলা ভেবে রেখেছে, বাবা বাড়ি এলে বাবার সাথে রাগ করে বসে থাকবে। কেন এমন করে বাবাটা?

পলার বাবা শহরে কাজ করে। দুই-তিন মাসে একবার বাড়িতে আসে। সংসারে টানপোড়েন যতই থাক না কেন, পলাকে তা বুঝতে দেয় না ওর বাবা। প্রতি ঈদে বাড়ি আসার সময় ওর জন্য নতুন জামা আনে। এ নিয়ে ওর মা মাঝেমাঝে বাবাকে রাগ করে, বাবা শোনে না।

পলারা গ্রামে থাকে। গ্রামে ওদের ছোট্ট একটা মাটির ঘর আছে। পলার দাদার ভিটেতে দাঁড়িয়ে আছে সেটা। ওর মা গ্রামের এক অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে কাজ করে। আর ছয় বছরের পলা সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে। ওর বন্ধু নেই বেশি। স্কুলেও যায় না। বাবা অনেকবার স্কুলে দিতে চেয়েছে, মা বলেছে গরিবের এত লেখাপড়া শিখে কোনো লাভ নেই। পলা তো আর পড়াশুনা করে ব্যারিস্টার হবে না, শুধু শুধুই টাকা নষ্ট করা। অনেক চেষ্টা করে বাবা শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে। পলারও স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না মোটেও। সেজন্য বাবার কথায় তেমন গা করেনি। বাড়িতে বসে আকাশ দেখতেই ওর ভালো লাগে। সারাদিন ও আকাশের দিকেই তাকিয়ে থাকে।

আকাশের সাথে কথা বলে। আকাশ একবার নীল হয়, একবার কালো হয়। সন্ধ্যার আগে আগে গোলাপি আর লাল হয়। পলার দেখতে ভালো লাগে।

আর ভালো লাগে গাঁয়ের মেঠো পথটার দিকে চেয়ে থাকতে। এই পথটা দিয়েই বাবা শহর থেকে ফিরবে। তার জন্য নিয়ে আসবে নতুন জামা, চুড়ি-ফিতে-কত কী!

কিন্তু এবার কেন বাবা আসছে না? পলার খুব রাগ হয়। গত ঈদেও বাবা ঈদের দুইদিন আগে চলে এসেছিলো। পলার মনে আছে, তখন বিকেল ছিল। সে চেয়ে ছিল ওই মেঠো রাস্তার দিকে। হঠাৎ দেখলো দূরের নীলিমা থেকে আকাশের নীল থেকে একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। যেন দূর আকাশ থেকে কেউ নেমে আসছে। প্রথমে অত গুরুত্ব দেয়নি। এমন সে সারাদিনই দেখে। এই পথে অনেক মানুষ যাতায়াত করে। কিন্তু অবয়বটা যখন আরো কাছে আসতে লাগল, স্পষ্ট হতে লাগল, পলা চিনতে পারল-তার বাবা!

বাবার হাতে একটা ব্যাগ ছিল। বাবা একটু কাছে আসতেই পলা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। বাবা ওকে আদর করে কোলে নিলেন।

ঘরে ঢুকে বাবা ওই ব্যাগটা খুললেন। একটা নতুন জামা বের করলেন। পলার গায়ে মাপ দিয়ে বললেন, এইটা তোর জন্য পলা। পছন্দ হইছে? তোরে খুব সোন্দর লাগব। এক্কেরে হইলদা পাখির লাগান দেখাইব। আমি কেনার সময়ই বুঝছিলাম।

পলা বাবার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল নতুন হলদে রঙের জামাটা। অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর সেটাকে বুকে জড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।

কী মজার ছিল সেই ঈদটা! পলার জামাটা দেখে সবাই বলেছিল, কী সুন্দর হয়েছে!

কিন্তু এবার ঈদে বাবা আসছে না কেন?
বাবা অনেকদিন বাড়ি আসে না। কেন? এই সেদিনও তো পলারা গিয়েছিল শহরে। বাবাকে কত খুঁজল! কোত্থাও পেল না। কোথায় গেছে বাবা?

সেদিনটা পলার খুব মজার দিন ছিল। কে একজন এসে খবর দিল, পলার মা, পলার মা রে... সর্বনাশ হয়ে গেছে রে... রানা প্লাজা ধইস্যা পড়ছে। কত্ত মানুষ মইরা গেছে, কতজনের আবার খুইজ্জা পাইতেছে না। পলার বাপের খোঁজ নাও একখান।

পলার মা চিৎকার করে উঠেছিল। সেদিনই ওরা বাসে করে শহরে গিয়েছিল। পলা কতদিন যেতে চেয়েছিল শহরে! খুব মজা পেয়েছিল ও। শহর কী সুন্দর! কতো বড় বড় দালান, কত গাড়িঘোড়া, মানুষ! ওই মানুষেরা কেন যেন খুব মন খারাপ করে ছিল। কেউ কেউ কাঁদছিল। সব মানুষের ভিড়ে মা বাবার একটা ছবি হাতে বাবাকে খুঁজছিল। কেন? বাবা লুকোচুরি খেলছে নাকী?

ওরা বারোদিন ছিল শহরে। বাবাকে খুব খুঁজেছে। পায়নি। তখন পলার ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। বাবা কোথায় গেল? এত খোঁজাখুঁজি করার পরও আসে না কেন?

কিন্তু এই বারোটা দিন পলার জীবনে বিভীষিকা হয়ে আছে আজও। ও শহরে গিয়েছিল খুব আনন্দ নিয়ে, বাবাকে খুঁজতে। কিন্তু ওই বারোদিনে সে অনেক কিছু দেখেছে। অনেককিছু। কত কত মানুষ পাগলের মতো ছুটছিল, তাদের মধ্যে তার মা-ও ছিল। কতো মানুষ বুক চাপড়ে কাঁদছিল। সেই দলেও তার মা ছিল। অনেকে আঁচলে চোখ মুছছিলো। কেউ কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল।

একটা বড় দালান ভেঙে পড়েছিল। সেই দালানকে ঘিরেই এত সব। সেখানে ছিল অনেক মানুষ। পলাদের পুরো গ্রাম মিলেও এত মানুষ নেই। এত মানুষ কখনো সে দেখেনি। ওই ভাঙা দালানে অনেকে ঢুকেছিলো। কিন্তু ওদেরকে ঢুকতে দিচ্ছিলো না তারা। তারা অনেক মানুষকে বের করে এনেছিলো। মানুষগুলোর শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছিল, কেউ কেউ চিৎকার করছিলো। কেউ চুপচাপ শুয়েছিলো। কথা বলছিলো না। নড়ছিলোও না। কী হয়েছিলো তাদের?

বারোদিনের দিন বাবাকে সারাদিন খুঁজে না পেয়ে রাতে ওরা বাসে উঠেছিলো বাড়ি ফেরার জন্য। মা খুব কাঁদছিলো। আর পলার রাগ হচ্ছিল।   বাবা এমন ফাঁকিবাজি কেন করছিলো?

পরশুদিন ঈদ। বাবা এখনো বাড়ি আসেনি। পলার এখনো খুব খুব রাগ হচ্ছে। তবুও সে ঘরের দরজায় মাথা ঠেকিয়ে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে আসা সাপের মতো মেঠো পথটার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব আশা তার। বাবা আসবে। তার জন্য সুন্দর জামা নিয়ে। কেমন হবে সেই জামা? লাল, নীল না সবুজ? নাকী হলদে বা বেগুনি রং? নাকী এবার অন্য কোনো রঙের জামা আনবে বাবা? পলার মনে একটা খুশির পাখি নাচানাচি করছে। সেদিন বাবা আসলে লুকোচুরি খেলছিলো। এই জন্য বাবাকে ওরা খুঁজে পায়নি।

বাবা চেয়েছিল ঈদের সময় তার জন্য নতুন কাপড় নিয়ে হঠাৎ চলে এসে চমকে দিতে। উফ! কখন যে আসবে বাবা! কেন আসছে না? পলা তো আর অপেক্ষা করতে পারছে না। কতদূর এসেছে বাবা এখন? এখন কী বাসে উঠল? নাকী বাস থেকে নামছে? নাকী এখন বাসস্ট্যান্ড থেকে ভ্যানে চড়ে গ্রামের দিকে রওনা হবে? একটু পরেই দেখা যাবে আকাশের নীলিমা থেকে একটা মানুষ নেমে আসছে। আরো কাছে... আরো কাছে... আর পলা দেখবে, সেটা তার বাবা। পলা অধীর আগ্রহের সাথে মেঠো পথটার দিকে চেয়ে থাকে।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।