ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

কিশোর নেতা শেখ মুজিব

ইমরুল ইউসুফ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৩
কিশোর নেতা শেখ মুজিব

আমাদের সুন্দর এই দেশে জন্ম হয়েছে অনেক বিখ্যাত মানুষের। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রমুখ কৃতি সন্তানদের জন্ম দিয়ে গর্বিত বাংলাদেশ।

এঁদের সবারই জন্ম বাংলাদেশে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম বাংলাদেশে না হলেও তারা বাঙালি। এদেশের মানুষকে ঘিরেই তাদের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের সাফল্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এদের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন কৃতী সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে তিনি জাতির জনকের সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এদেশের মানুষকে ভালোবেসে তিনি উপাধি পেয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
Mujib-3
ছোটবেলা থেকেই মুজিব ছিলেন স্বাধীনচেতা, দুরন্ত এবং সাহসী। সেই সঙ্গে ছিলেন কোমল হৃদয়েরও অধিকারী। ছোটবেলায়ই তিনি কতোটা কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তার দু’টি ঘটনা এখন বলব। তিনি তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। প্রাইভেট পড়তেন স্কুলের শিক্ষক রসরঞ্জন সেনগুপ্তের বাড়িতে। একদিন সকালে পড়া শেষ করে স্যারের বাড়ি থেকে ফেরার সময় দেখলেন ছোট একটি ছেলে খালি গায়ে রাস্তার পাশে বসে আছে। দেখে তার এতোই মায়া লাগলো যে তিনি তার গায়ের গেঞ্জি ও প্যান্ট খুলে দিলেন। তারপর গায়ে দেওয়া চাদরটি পরে খালি গায়ে ফিরে এলেন বাড়িতে।

আরেক দিনের ঘটনা। ভালো ফসল না হওয়ায় সেবার টুঙ্গিপাড়ায় দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছিলেন। মুজিব গোপালগঞ্জ শহর থেকে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন। তারপর বাবার অনুপস্থিতিতেই তাদের গোলায় রাখা ধান অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। বাবা বাড়ি ফিরে এই ঘটনা শুনলেন এবং দেখলেন। বাবা চেনেন তার সন্তানকে। তাই মুজিবকে কিছুই বললেন না।

ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সত্য ও উচিত কথা বলার সাহস থাকায় কারো সামনেই তিনি কথা বলতে ভয় পেতেন না। সে খেলার সাথী, সহপাঠী অথবা স্কুলের শিক্ষকই হোক।

গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন গিরীশ বাবু। সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার জন্য তিনি কিশোর মুজিবকে খুব পছন্দ করতেন। মিশন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ সহপাঠী ও ছোটদের মন জয় করে নিলেন তিনি। হয়ে উঠলেন সবার ‘মুজিব’ কিংবা ‘মুজিব ভাই’। কেউ আবার বলতো ‘মিয়া ভাই’। mjib-2

স্কুলের যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে মিয়া ভাইয়ের থাকতো সক্রিয় ভূমিকা। যে কোনো কাজে মুজিব এগিয়ে গেলে অন্য ছাত্ররাও তার সঙ্গে এগিয়ে যেতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে ছাত্রদের কোনো আবদার আবেদন দাবি বা অভিযোগের ক্ষেত্রে আগে এগিয়ে যেতেন মুজিব। কৈশোরেই মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বের যে গুণাবলী দেখা দিয়েছিল, তা পরবর্তীতে প্রতিফলিত হয়েছিল তার জীবনে।

শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স তখন ১৪ বছর। পড়েন সপ্তম শ্রেণীতে। এসময় তিনি ‘বেরি বেরি’ রোগে আক্রান্ত হন। এজন্য স্কুলে যেতে পারেননি ৩ বছর। এরপর ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে ভর্তি হন অষ্টম শ্রেণীতে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই তিনি প্রথম জেলে যান। তাহলে এখন জেলে যাওয়ার সেই ঘটনাটা বলি।

১৯৩৮ সাল। মুজিব তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। স্বনামধন্য নেতা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একসঙ্গে গোপালগঞ্জ সফরে আসেন। জনসভার পাশাপাশি তারা তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলও পরিদর্শন করেন।

স্কুল প্রাঙ্গণের সভা শেষে তারা দুজন গোপালগঞ্জের ডাকবাংলোয় ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মিশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিলাস বাবু এবং স্থানীয় গণ্যমান্য মানুষ। কিশোর মুজিব কয়েকজন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পথরোধ করে দাঁড়ালেন। প্রধান শিক্ষকসহ সবাই তো অবাক। তারা মুজিবসহ অন্যদেরকে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ওই দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর সামনে থেকে সরে যেতে বললেন। কিন্তু তারা অনড়, মন্ত্রীদের কাছে তাদের দাবি না জানিয়ে সরবেন না। শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনই অবাক হয়ে মুজিবকে দেখলেন। জানতে চাইলেন তাদের দাবির কথা। মুজিব মন্ত্রীদের সামনে এগিয়ে গিয়ে তাদের স্কুলের হোস্টেলের ভাঙা ছাদের কথা এবং ছাদ থেকে পানি চুইয়ে তাদের বইখাতা, বিছানাপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বললেন। আরো বললেন, হোস্টেলের ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা না করে গেলে তারা মন্ত্রীদের পথ ছাড়বেন না। অবশেষে মুজিবের কথা মতোই হোস্টেলের ছাদ মেরামতের খরচ হিসেবে শেরেবাংলা তার ঐচ্ছিক তহবিল থেকে ১২শ’ টাকা মঞ্জুর করলেন।

ঘটনার শেষ কিন্তু সেখানেই নয়। শেরে বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জনসভাকে ঘিরে গোপালগঞ্জের স্থানীয় লোকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের মাসখানেক পর কিশোর মুজিবকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর ৭ দিন তিনি কারাগারে ছিলেন। এরও আগে গোপালগঞ্জের এক জনসভায় গোলযোগের কারণে পুলিশ মুজিবকে ধরে থানায় নিয়ে যায় এবং তার বয়স ১৩ বছর হওয়ার কারণে থানার দারোগা তাকে সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দেন। এভাবেই কিশোর মুজিব জনমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
mjib-12
নেতা হয়ে ওঠার আরেকটি গল্প বলেই শেষ করবো কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানের গল্প। তখন তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র। টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারকে না জানিয়ে এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি পাটগাতী বাজারে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। আমন্ত্রণ জানায় এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। মুজিব তখন গোপালগঞ্জ শহর থেকে গ্রামে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। এসেই শুনলেন এই ঘটনা। আমন্ত্রিতদের তালিকায় দেখলেন তাদের পরিবারের কারো নাম নেই। এমনকি ইউনিয়ন বোর্ডের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ আবদুর রশীদ ওরফে নশু মিয়াকেও (মুজিবের দাদা) আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যাই হোক, সভার দিন এলাকার তরুণ ভক্তদের নিয়ে মুজিব সভাস্থলে গেলেন। সভার শুরুতেই আয়োজকদের দুই একজন তাদের পরিবারের সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে অসত্য বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সে সময় মুজিবুর রহমান ভিড় ঠেলে সোজা মঞ্চে উঠে যান। যিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তাকে বক্তৃতা দিতে বারণ করেন। এবং উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে জোর গলায় বলেন, যে সভায় শ্রদ্ধেয় মুরব্বিদের নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয় সে সভায় আমাদের থাকা উচিত নয়। সভায় শেখ পরিবারের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। তারা সবাই শেখ পরিবারকে শ্রদ্ধা করতেন। তাই মুজিব সভাস্থল ত্যাগের আহ্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় হৈ চৈ। মুহূর্তেই সবাই সভা ছেড়ে চলে যান এবং সভা প- হয়। পরে অবশ্য শেখ পরিবারের উদ্যোগেই পাটগাতীতে স্থাপন করা হয় একটি স্কুল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন অনন্য সংগ্রামী এক মানুষের জীবন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ধীরে ধীরে একজন নেতা হয়ে উঠছিলেন। ভালোবাসা, মানবিকতাবোধ, প্রাণশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শী চিন্তা, সাংগঠনিক ক্ষমতা আর নেতৃত্বের গুণাবলী দিয়ে তিনি মানুষকে মুগ্ধ করেছিলেন। এদেশের মানুষের পরাধীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন ১৯৭১ সালে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।