সত্যি! সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে। ভোলা পুরনো টিনের থালাটা থেকে এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে ভাবল, এমন ভালো সময় তাদের কখনো আসেনি।
ভোলাদের এমন সুসময়ের জন্য অবশ্য সব কৃতিত্বের দাবিদার ভোলার মা। সে এতদিন স্বামীর আয় থেকে টাকা বাঁচিয়ে, বাসায় বাসায় কাজ করে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে একটা গাই কিনেছে। গাইটার অনেক সেবা-যত্ন করে সেটাকে খাইয়ে দাইয়ে মোটাতাজা করেছে।
গাইটার একটা বাছুর হয়েছিল। তারপর গাইটার দুধ বেচে নিয়মিত অল্প অল্প করে বেশ কিছু টাকা হাতে এসেছে। গাইয়ের বাছুরটাকে খুব পছন্দ ছিল ভোলার। কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর মা ওটাকে বিক্রি করে দিয়েছে। ব্যস! অনেক টাকা চলে এসেছে। সেজন্যই এখন ভোলাদের এমন সুদিন। মা অবশ্য টাকাগুলো পুরোটাই অযথা সংসারের পেছনে না ঢেলে এর সাথে আরো কিছু টাকা মিলিয়ে আরেকটা গাই কিনে ফেলেছে। এভাবে করে গাইয়ের দুধ বেঁচে, বাছুর বেঁচে টাকা জমিয়েছে মা। এমনি করে মায়ের চেষ্টায় ভোলাদের এখন তিনটে গরু, দুটো বাছুর। একটা আবার দুধেল গাই। এই গরুগুলো ওদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। অভাবের সংসারে এনেছে সুখের আলো।
ভোলার মায়ের খুব ইচ্ছে ভোলা স্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে। তারপর লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াবে। সবাই চিনবে তার ভোলাকে। তবেই তার আর দুঃখ থাকবে না।
কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না ভোলার মা পারভিনের। স্বামী ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালায় আর সে নিজে কাজ করে মানুষের বাড়িতে। যা আয় করে দুজন মিলে তাতে সংসার চালানোই দায়। তারপর ভোলাকে স্কুলে দেওয়া তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবুও না খেয়ে থেকে ভোলাকে স্কুলে পাঠিয়েছে পারভিন। কিন্তু এরপর সেটাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন তাই ভোলার স্কুল বন্ধ ছিল। তারপর পারভিনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভোলা এখন আবার স্কুলে যাচ্ছে।
ভোলা প্রায়ই বসে ভাবে, এভাবে একদিন তারা অনেক বড়লোক হবে। সে স্কুলে যেয়ে যেয়ে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে। সেই স্বপ্নপূরণ হবে কবে? কতদিন পর? ভোলা অপেক্ষা করে থাকতে পারে না। ধৈর্য রাখতে পারে না আর। তাই কল্পনায় সেদিনের একটা ছবি এঁকে ফেলে। সেই ছবি দেখেই উত্তেজনায় গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।
সুসময়ের পর দুঃসময় আসে এমন একটা কথা শুনেছিল ভোলা। তবে কথাটা যে এত সত্যি সেটা বুঝতে পারেনি। কেন এমন হয়?
একটা রাতের মধ্যে এভাবে ভোলার সব স্বপ্ন কী করে ডানা ভাঙা পাখির মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল?
ভোলাদের গোয়াল ঘর নেই। গরুগুলো তাই উঠোনেই বাঁধা থাকে। গতকাল রাতে ওদের দুধের গাইটা চুরি হয়ে গেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না।
পারভিন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। এই গরু থেকে বেশ আয় হতো তার। তাছাড়া অনেক টাকা দিয়ে গরুটাকে কিনেছিল। আর সেই গাইটা... কে করল তার এমন সর্বনাশ? কেন করল? গাইটার বাছুরের কী হবে এখন?
ভোলা আজ স্কুলে যায়নি। সারাদিন মন খারাপ করে বসে ছিল। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে মায়ের বিলাপ আর বাবার চিৎকারে ঘুম ভাঙল ভোলার। ক্ষুধা পেটে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ও। এক চিলতে উঠোনটাতে মা বিলাপ করে কাঁদছে, সামনে পড়ে আছে কাল হারিয়ে যাওয়া গাইটার বাছুর। ভোলা ছুটে গেল মায়ের কাছে।
-কী হইসে মা? জানতে চাইল সে।
-বাছুরটাও মইরে গেছে রে ভোলা... এখন কী হবে? কে এমন কাজ করল রে? আল্লাহ তুমি তার বিচার করো... চিৎকার করতে লাগলেন মা। বাছুরটা কেন মারা গেল কেউ তা বুঝতে পারল না। তবুও ভোলার বাবা স্বান্তনা দিয়ে বলল, ‘থাইক গে।
এহনো দুটো গাই আছে, একটা বাছুর আছে। ইগুলান নিয়ে ভাবো। এই গাই দুটারে বেইচে দিয়ে না হয় দুধের গাই কিন্নে আনব একখান। আর কাইলই আমি ব্যবস্থা করছি গাইগুলান রাখার। ’
কিন্তু সে ব্যবস্থা করার আগেই সে রাতে তিন নম্বর গরুটা তার বাছুর সহ চুরি হয়ে গেল।
ভোলা ভেবে অবাক হলো কেন মানুষ তাদের গাইয়ের দিকেই শুধু নজর দিচ্ছে। গাঁয়ে অনেক উঁচু পরিবার আছে। তাদের গোয়াল ভরা গাই, গোলা ভরা ধান।
তাদের একটা গাই চুরি হলেও কোনো ক্ষতি হয় না। আর ভোলাদের মতো দরিদ্র পরিবারে একটা গাই চুরি হওয়া মানে তো পথে বসে যাওয়া। কে এমন সর্বনাশ করছে তাদের?
সেদিন রাতে ভোলাদের শেষ গরুটাকে ঘরে ঢুকিয়ে রাখা হলো। সারারাত গাইটার পাশে জেগে বসে থাকল ভোলা আর তার মা-বাবা। পরদিন সকালেই গাইটাকে হাটে নিয়ে অদামে বেচে ফেলল ভোলার বাবা। বাড়িতে এসে টাকাগুলো এনে পারভিনের হাতে দিতেই পারভিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, ‘খোদার এইটা কেমন বিচার? আমরা গরিব মানুষ। এত কষ্ট কইরা যখন ছাওয়ালডারে মানুষ করবার চাইলাম, ভাগ্যটা বদলাইবার চাইলাম, তখন ক্যান এই লিখল খোদায় আমার কপালে? আমি তো কিছুই চাই নাই। শুধু ইট্টু ভালো থাকবার চাইছি, আমার ভোলারে মানুষ করবার চাইছি। আমার ভোলারে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাইবার চাইছি। তাইলে ক্যান আমার লগে এ রকম হইল?’
মায়ের কান্না দেখে ভোলার চোখেও জল এসে যায়। সে বুঝতে পারে না কী বলবে মাকে। আস্তে আস্তে গিয়ে মায়ের পাশে বসে পড়ল সে। মায়ের আঁচলে চোখ মুছল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে মায়ের ভেজা চোখ দুটো কচি হাতে মুছে দিয়ে বলল, ‘কান্দিস না মা, আমি বড় হইয়া অনেক বড় ডাক্তার হমু, নাইলে অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার। তখন তোরে আমি আরেকটা সুন্দর গাই কিনে দিমু। তুই কান্দিস না মা। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৩
এএ/এমজেডআর-ichchheghuri@banglanews24.com