তুমি কী ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখো? নিশ্চয়ই দেখো। সারাদিন স্কুল, পড়াশুনা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর খেলাধূলার পর ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে কখন যে ঘুমের রাজ্যে ডুব দাও তা নিজেও টের পাও না।
স্বপ্নের মধ্যেই কেউ হয়তো ঘুরে ফেলো চট্টগ্রাম- রাঙামাটি-বান্দরবান, আবার কেউ সমুদ্রসৈকতে দৌড়ে বেড়াও লাল কাঁকড়ার পেছনে। কখনো হয়তো জয় করে ফেলো এভারেস্ট কিংবা হয়ে যাও বড় মাপের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার- লেখক। কে জানে, স্বপ্নের মধ্যেই হয়তো তোমাকে পেন্সিল দিয়ে খোঁচা দেওয়া দুষ্টু বন্ধুটিকে এক হাত দেখে নাও। আবার স্বপ্নের দেশে গিয়ে ভূতের খপ্পরেও পড়েছ অনেকে।
আমি কিন্তু স্বপ্নে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, পড়ন্ত বিকেলে ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র সৈকত, টেমস নদীর ধার থেকে আইফেল টাওয়ার পর্যন্ত ঘুরে ফেলেছি।
এরকম হাজার রকম স্বপ্ন আমরা প্রতিদিন দেখি। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, চাওয়া-পাওয়া বা ইচ্ছেগুলো- সবই ধরা দেয় ঘুমের রাজ্যে স্বপ্ন হয়ে। আফসোস, স্বপ্নে জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে ঘুম ভেঙে উঠে দেখবে তোমার বিছানায় একটা উপহারও নেই! সব স্বপ্নেই ফেলে এসেছ।
কিন্তু তুমি কী জানো স্বপ্ন আসলে কী?
স্বপ্ন হচ্ছে ঘুমের মধ্যে আমাদের এক ধরনের মানসিক অবস্থা যেখানে আমরা বিভিন্ন ধরনের কাল্পনিক দৃশ্যপট, ঘটনা বা নানাকিছু দেখে থাকি এবং তা অবচেতন ভাবে অনুভব করি। স্বপ্নের মধ্যে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোতে আমরা নিজেরাও অংশগ্রহণ করেছি বলে মনে করি। তবে স্বপ্ন কাল্পনিক হলেও একজন ব্যক্তির জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাস্তব ঘটনার সঙ্গে তার মিল থাকতে পারে। স্বপ্ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানা রকম ব্যাখ্যা থাকলেও মূলত অবচেতন মনের ভাবনাই ঘুমের মধ্যে আমাদের কাছে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়।
তুমি কী দাবি করতে পারবে যে তুমি কখনো স্বপ্ন দেখোনি? অনেকেই কিন্তু এমনটি বলে থাকে। তবে এখানে জানিয়ে দিই, যারা এমন বলে, তারাও আসলে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তারা স্বপ্নগুলোকে মনে রাখতে পারে না। প্রতিটি মানুষই স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বেশিরভাগ স্বপ্নই আমরা মনে রাখতে পারি না। স্বপ্ন দেখার ৫ মিনিটের মধ্যে আমরা তার ৫০ শতাংশ এবং ১০ মিনিটের মধ্যে ৯০ শতাংশ ভুলে যাই। ঘুম থেকে জেগে ওঠার অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ৯৫ শতাংশ স্বপ্ন ভুলে যাই।
আরো মজার কথা কী জানো? আমরা কিন্তু জীবনের প্রায় ছয় বছর পার করে ফেলি স্বপ্ন দেখে! তবে একসাথে না, একজন মানুষ সারা জীবনে যতো স্বপ্ন দেখে, তা একসাথে করলে প্রায় ৬ বছর হবে! আর প্রতি বছর মানুষ গড়ে কতগুলো স্বপ্ন দেখে জানো? ১৪৬০টি! আমাদের স্বপ্নগুলো সাধারণত ১০-১৫ মিনিট স্থায়ী হয়। তবে ভোর বা সকালে আমরা সবচেয়ে বেশি লম্বা স্বপ্ন দেখি যার স্থায়িত্ব হয় ৩০-৩৫ মিনিট।
এবার আসি স্বপ্নে দেখা চরিত্রগুলোর কথায়। প্রায়ই আমরা স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে বলি, একটা অচেনা মানুষকে দেখেছি যাকে আমি সত্যি সত্যি কখনো দেখিনি। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক কোনো চেহারা তৈরি করার ক্ষমতা রাখে না। বিভিন্ন সময়ে দেখা মানুষগুলোকেই সচেতন ভাবে আমরা মনে না রাখলেও অবচেতন মন ধরে রাখে। আর সেসব চেহারাগুলোই স্বপ্নে এসে হাজির হয়। অর্থাৎ আমাদের স্বপ্নে দেখা মানুষগুলোকে জীবনের কোনো না কোনো সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও আমরা দেখেছি।
স্বপ্ন নিয়ে অনেক কথা হলো। কিন্ত ঘুমের কোন সময়ে আমরা স্বপ্ন দেখি তা কী জানো? ঠিক আছে, বলে দিচ্ছি। আমরা তখনই স্বপ্ন দেখি যখন আমাদের REM অর্থাৎ Rapid Eye Movement হয়। Rapid Eye Movement মানে নিশ্চয়ই জানো। এটার অর্থ হচ্ছে খুব দ্রুত চোখের পাতা নড়া। তাই ঘুমন্ত কারো চোখের পাতা যদি খুব দ্রুত নড়ে, তাহলে বুঝে নেবে সে স্বপ্ন দেখছে।
স্বপ্নের একটা বিষয় নিয়ে অনেকেরই দ্বিধা রয়েছে। সেটি হচ্ছে স্বপ্ন কী রঙিন নাকী সাদাকালো। এই প্রসঙ্গ উঠলেই দেখা যাবে এ নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত আছে। কেউ বলবেন স্বপ্ন রঙিন, তো কেউ বলবেন সাদাকালো।
এই ঝামেলাটা চলো মিটিয়ে ফেলি। আগে বলা হতো স্বপ্ন সাদাকালো। বিশেষজ্ঞরাও অনেকেই এর সাথে একমত হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে স্বপ্ন রঙিন বা সাদাকালো দুই রকমই হতে পারে। ৮০ শতাংশ মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখে। তবে কেউ কেউ সাদাকালো স্বপ্নও দেখে থাকে।
আরো মজার কথা হচ্ছে চোখে দেখতে না পেলেও অন্ধ ব্যক্তিরাও স্বপ্ন দেখেন। তবে তাঁদের ক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখা না বলে স্বপ্ন শোনা বলা যেতে পারে। তারা স্বপ্নে শুধু শব্দ শোনেন।
কোনো কোনো স্বপ্ন দেখে তুমি আনন্দ পাও। যেমন ধরো পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করার স্বপ্ন দেখে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ফেলো। সারাটাদিনই ভালো কাটে। আবার কখনো উলটো স্বপ্নও দেখো যেখানে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়ে যায়। এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমরা কিন্তু ভালো স্বপ্নের চেয়ে খারাপ স্বপ্ন তুলনামূলক ভাবে বেশি দেখি।
ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে, দেশি-বিদেশি- সব মানুষই স্বপ্ন দেখে। তবে একেকজনের স্বপ্ন একেক রকম। মানুষ সাধারণত তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তার সমাজ, নিজের জীবন, নিজের চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে, দুঃখ, ভয় বা আতংকের বিষয়গুলো নিয়েই স্বপ্ন দেখে। তবে ছেলেদের আর মেয়েদের স্বপ্নে কিছু পার্থক্য আছে। মেয়েদের স্বপ্নে ছেলেদের চেয়ে বেশি চরিত্রের উপস্থিতি থাকে এবং তাদের স্বপ্ন ছেলেদের স্বপ্নের তুলনায় লম্বা হয়।
আরেকটা মজার তথ্য দিই। কখনো কখনো কিন্তু তুমি চাইলেই তোমার স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো। অর্থাৎ স্বপ্নটা দেখতে শুরু করার পর সেটা কীভাবে আগাবে, এরপর কী হবে- সেটা তুমিই ঠিক করতে পারো। অনেক সময় স্বপ্ন দেখার সময় মানুষ টের পায় যে সে ঘুমাচ্ছে এবং স্বপ্ন দেখছে। এটা বাস্তবে ঘটছে না। আর যখনই সে এটা টের পায়, তখনই সে স্বপ্নটাকে তার ইচ্ছেমতো দেখতে পারে।
স্বপ্ন নিয়ে জানা হলো অনেক কিছু। মানুষ তো স্বপ্ন দেখেই। কিন্তু একটু কী জানতে ইচ্ছে হচ্ছে পশু-পাখিও স্বপ্ন দেখে কীনা? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে বিজ্ঞানীদের ধারণা কোনো কোনো পশু-পাখি হয়তো স্বপ্ন দেখে। কারণ ঘুমের সময় বিভিন্ন পশুপাখির রেম হয়।
স্বপ্ন নিয়ে কিন্তু গবেষণা হয়। বিজ্ঞানের একটা আলাদা শাখাই আছে স্বপ্ন বিষয়ক। এই শাখাটিকে বাংলায় স্বপ্নবিজ্ঞান এবং ইংরেজিতে Oneirology বলে।
স্বপ্ন দেখা আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলোর মধ্যেই পড়ে। শুধু রাতে না, কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে দিনেও। কেউ আবার কোনো অপছন্দের শিক্ষকের বিরক্তিকর পড়া শুনতে শুনতে বেঞ্চে মাথা এলিয়ে দিয়েই ঘুমিয়ে গিয়ে ক্লাসেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
স্বপ্ন নিয়ে আমরা অনেক জানলাম। তো, আজ রাতে কী স্বপ্ন দেখতে চাও তুমি? স্বপ্ন বিষয়ক মজার এসব তথ্য নিয়েই একটা স্বপ্ন দেখে ফেলবে নাকী? দেখেও যদি ফেলো, তাহলেও চিন্তার কিছু নেই। বাস্তবেই যেহেতু তুমি লেখাটা পড়ে ফেলেছ, তাই স্বপ্নে দেখে ফেললেও কোনো তথ্য ভুলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩
এএ/আরকে-ichchheghuri@banglanews24.com