ঢাকা: নেলসন ম্যান্ডেলা। যাঁর নাম শুনলে মনে জাগ্রত হয় অসীম সাহস, বাধাকে অতিক্রম করার শক্তি, মানুষকে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে স্থান দেওয়ার অনুপ্রেরণা।
এই বিশ্বজয়ী নেতা, আফ্রিকার কালো মাণিক মাদিবা জোহনেসবার্গের নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৫ বছর বয়সে ছেড়ে গেলেন পৃথিবীর মায়া। তিনি ভুগছিলেন ফুসফুসজনিত রোগে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের আধিপত্য, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক শাসন ব্যাবস্থা চলছিল তখন আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহু বর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নের্তৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ট্রান্সকেই অঞ্চলের রাজধানী উমতাতার নিকটবর্তী মভেজো গ্রামে। আফ্রিকার থেম্বু রাজবংশের ক্যাডেট শাখায় তাঁর জন্ম হয়। বাবা গাদলা হেনরি মপাকানইসা ও মানেসোকেনি ফ্যানি।
ম্যান্ডেলার ছোটবেলা কাটে তাঁর নানাবাড়িতে। ডাকনাম ছিল রোলিহ্লাহ্লা। পারিবারিক নাম মাদিবা। ম্যান্ডেলা ছিলেন তাঁর পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়েছেন। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর এক শিক্ষিকা ইংরেজিতে তাঁর নাম রাখেন নেলসন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল পার্টি নামক আফ্রিকনাদের দল জয়লাভ করে। তারা ছিল বর্ণবাদী। ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার পরই ম্যান্ডেলা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯৬১ সালে ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখোন্তো উই সিযওয়ে (সংক্ষেপে এমকে) -এর নেতৃত্ব নেন। তিনি এই সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা করেন। ঃ
প্রয়োজনে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনাও করেন ম্যান্ডেলা। ১৯৮০’র দশকে এমকে বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করে। সে যুদ্ধে মারা যায় অনেক বেসামরিক লোক। পরবর্তীতে সেকথা স্বীকার করেন ম্যান্ডেলা।
১৯৬২ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতা সহ নানা অপরাধে গ্রেফতার করে। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবাসের ১৮ বছর কাটে রবেন দ্বীপের কারাগারে। ১৯৮৮ সালে তাঁকে ভিক্টর ভার্স্টার কারাগারে নেওয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত পরবর্তী সময়টুকু তিনি ছিলেন এখানেই।
কারাবাসে থাকাকালীন বিশ্বব্যাপী ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বর্ণবাদবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ম্যান্ডেলার দীর্ঘ কারাবাসের অবসান ঘটে।
মুক্ত হওয়ার পর নেলসন ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এই দলের নেতা ছিলেন তিনি। সে সময়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হয়। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রথম জাতীয় সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে ম্যান্ডেলাকে দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় অবদান রাখার জন্য ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ম্যান্ডেলা। এছাড়াও শাখারভ পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি।
২০০৯ সাল থেকে জাতিসংঘের ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
অমর ম্যান্ডেলা তুমি। তুমি বেঁচে থাকবে পৃথিবীর কোটি মানুষের মাঝে, কোটি কোটি বছর ধরে।
উল্লেখ্য, ১৯১৮ সালে আফ্রিকার থেম্বো রাজ পরিবারে জন্ম ম্যাল্ডেলান। জন্মের পর তার নাম রোলিহ্লাহলা ডালিভুঙ্গা মানডেলা রাখা হলেও আফ্রিকার আপামর মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন মাদিবা নামেই।
ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর বারবার যেন কানে ভেসে আসছে বাংলাদেশের গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীরের গাওয়া ব্যাপক জনপ্রিয় সেই গানটি, আর ভিজে যাচ্ছে চোখ:
কালো কালো মানুষের দেশে
ওই কালো মাটিতে
রক্তের স্রোতের শামিল
নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি
অমর কবিতার অন্ত্যমিল...
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩