শেষ হলো আরও একটি বছর। নতুন বছর ২০১৪ সাল দ্বার গোড়ায়।
নোবেল পুরস্কারের মতো এত সম্মানের, এত মোটা অংকের অর্থ পুরস্কার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। নোবেল মৃত্যুবরণ করার আগে ঘোষণা করেছিলেন, পুরস্কারটি দাতা সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী পৃথিবীর যে কোনো জাতির মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য লাভ করতে পারবে। তার নির্দেশ বা উইল অনুযায়ী ১৯০১ সাল থেকে ৫টি বিষয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে আরো একটি বিষয়ে মোট ৬টি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। বিষয়গুলো হলো- পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতি।
নোবেল পুরস্কার ২০১৩ প্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো:

১৯৬০ সালে অতিপারমাণবিক কণার (সাব অ্যাটোমিক পার্টিকল) ভরের উৎস খুঁজতে গিয়ে ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট ও যুক্তরাজ্যের পিটার হিগসসহ একদল কণাতত্ত্ববিদ একটি মডেল প্রস্তাব করেন। যে মডেলের মাধ্যমে পরমাণুর কিছু প্রাথমিক কণার ভরের উৎস ব্যাখ্যা করা হয়। ওই মডেলে মূলত একটি অনুপস্থিত কণার কথা বলা হয়, যার নাম দেওয়া হয় হিগস-বোসন। ওই মডেলে একটি কণার কথা বলা হয়, যার নাম রাখা হয় পিটার হিগস ও বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে। তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার এই মত অনুযায়ী মহাবিশ্বের সবকিছুই ‘ভর’ পেয়েছে এই হিগস-বোসন কণার মাধ্যমে। এ কারণে এই কণার নাম হয়ে যায় ঈশ্বর কণা। তাদের বয়স এখন আশির কোঠায়। হিগস স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা এবং ইংলার্ট ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলসে অধ্যাপনা করেন।

একাডেমি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয় বিদ্যুৎ গতিতে। ইলেকট্রন কণাগুলো পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মধ্যে এমনভাবে লাফঝাঁপ করে, যা বিজ্ঞানীদের উৎসুক চোখেরও অগোচরে থেকে যায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নোবেলজয়ীরা কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে রসায়নের রহস্যময় পথগুলোর মানচিত্র আঁকার কাজটি সম্ভব করেছেন। আজকে টেস্টটিউবের মতোই কম্পিউটারও একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। ’
ব্রিটিশ ও মার্কিন নাগরিক লেভিট যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক। মার্কিন-অস্ট্রীয় নাগরিক কারপ্লাস গবেষণা করেন ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর মার্কিন-ইসরায়েলি নাগরিক ওয়ারশেল যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক। পুরস্কার পাওয়ার পর ওয়ারশেল প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নোবেল কমিটি যখন আমাকে ফোন করে পুরস্কার প্রাপ্তির খবর জানায় লস অ্যাঞ্জেলেসে তখন মধ্যরাত। ঘুম নষ্ট হলেও এ খবরে আমি দারুণ খুশি।

গবেষক শেকম্যান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিক্যুলার ও সেল বায়োলজির অধ্যাপক। কোষ পরিবহনের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় যেসব জিনের মাধ্যমে, তা শনাক্ত করেছেন তিনি। আর ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেল বায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জেমস রথম্যান সন্ধান পেয়েছেন একটি প্রোটিন যৌগের। এই প্রোটিনের কাজ ভেসিকল বা রাসায়নিক অণুর প্যাকেজ স্থানান্তরে সহায়তা করে। শেকম্যান ও রথম্যানের উদ্ভাবনের পরবর্তী ধাপটি সম্পন্ন করেছেন জার্মানির নাগরিক ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থমাস সুডহফ। আর এর স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের তিনজনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

অ্যালিস মানরো ১১০তম লেখক হিসেবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতি পেয়েছেন। আর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নারীদের মধ্যে তিনি ১৩তম। ‘ডিয়ার লাইফ’ ও ‘ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস’ মানরোর বহুল আলোচিত ছোটগল্প।
৮২ বছর বয়সী এ ছোটগল্পকার কিশোর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘দ্য ডাইমেনশনস অব এ শ্যাডো’ প্রকাশিত হয়। তিনি সে সময় ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রকাশিত বই ‘ড্যান্স অব হ্যাপি শেডস’ কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার গভর্নর জেনারেল পান। শুধু তাই নয়। ২০০৯ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কারও লাভ করেন। মানরো তাঁর লেখায় মানবীয় চেতনা ও ছোট শহরগুলোতে মেয়েদের বেড়ে ওঠার পেছনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ফুটিয়ে তোলেন। পুরস্কার পাওয়ার পর মানরো তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি জানতাম আমি পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় আছি। তবে হ্যাঁ, আমি কখনোই চিন্তা করিনি যে আামই জিতব।

পাকিস্তানের সাহসী কিশোরী মালালা ইউসুফজাই সারা বছর আলোচনায় ছিলেন এ ক্যাটাগরিতে নোবেল পেতে পারেন বলে। মনোনয়নও পান তিনি। দবে নোবেল না পেলেও অনেকগুলো পুরস্কার এবার গেছে তার ঝুলিতে।

১৯৩৯ সালে বস্টনে জন্ম নেওয়া ইউজিন ফামা অধ্যাপনা করছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৬ সালে ডেট্রোয়েটে জন্ম নেওয়া শিলার অধ্যাপনা করছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ১৯৫২ সালে জন্ম নেওয়া পিটার হ্যানসেনও বর্তমানে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন।
সুপ্রসিদ্ধ রসায়ন বিজ্ঞনী, সমাজ বিজ্ঞানী, বহু-ভাষাবিদ, ব্যবসায়ী, কবি ও চিরকুমার স্যার আলফ্রেড বার্নাড নোবেল (১৮৩৩-১৮৯৬) প্রবর্তন করেন নোবেল পুরস্কার। ডিনামাইটের আবিষ্কারক এবং জনক হিসেবে নোবেলকে বলা হয় ‘লর্ড ডিনামাইট’।
বিজ্ঞান ছিল নোবেলের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। তিনি মনে করতেন একমাত্র বিজ্ঞানই পারে মানুষকে সংস্কারমুক্ত, বাস্তবসম্মত উন্নত জীবনের সন্ধান দিতে। এই আত্মবিশ্বাস থেকেই নোবেল বিশ্ববাসীর কল্যাণে ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর এক উইলের মাধ্যমে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মানুষের উন্নয়নকর্মের স্বীকৃতির জন্য দান করে যান। নোবেলের উইল অনুসারে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হয়ে আসছে। পুরস্কারদাতার নাম অনুসারেই নাম হয়েছে ‘নোবেল পুরস্কার’।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর