বর্ষাকাল। দু’দিনের টানা বৃষ্টিতে পথ, ঘাট, মাঠ পানিতে একাকার।
বৃষ্টির জন্য বাইরে যেতে না পারায় আকাশের মেজাজটা খারাপ। দু’দিন ধরে সে স্কুলে যেতে পারছে না। খেলাধুলাও তাই বন্ধ। স্কুলে যেতে পারলে অন্তত মাঠে ফুটবল নিয়ে ছুটোছুটি করা যেত।
তুষার, আল আমিন, শান্তি— ওরাও কি ঘরে বন্দী? একটু খোঁজ নিতে পারলে হতো। কিন্তু কিভাবে খোঁজ নেবে, সে নিজেই তো ঘরে বন্দী। বের হওয়ার চেষ্টা করলেই বাবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর— ‘বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর আসবে। সামনেই সাময়িক পরীক্ষা। ’ কী আর করা! অগত্যা ঘরেই থাকতে হয়। আকাশ ভাবে, যদি বৃষ্টিটা শুধু রাতেই হতো, বেশ মজা হতো। স্কুলের ক্লাস শেষে মাঠে মনের আনন্দে ফুটবল খেলা যেত। আর বাড়ি এসে মায়ের কাছে সেই মুখস্থ গল্প, ‘আম্মু, মাঠে পড়ে গেছি!’
তিনদিন পর বৃষ্টি থামে। অবশেষে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি মিললো তার। যদিও সূর্যের দেখা নেই, মেঘলা আকাশ।
যশোর জিলা স্কুলে ক্লাস সেভেন। মনের আনন্দে ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলে ছোটে সে। ঘর থেকে বের হয়ে মোড় পর্যন্ত যেতেই তার মনে পড়লো ফার্স্ট-এইড বক্সটা আনা হয়নি। ফিরে বাড়ি ছুটলো আকাশ। ফার্স্ট-এইড বক্সটা ব্যাগে ভরেই আবার দৌড়। এই বক্সটা আকাশের নিজের তৈরি। সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা’র অধ্যায় পড়ে এই চিন্তা তার মাথায় আসে। একটি প্লাস্টিকের বাক্স জোগাড় করে তাতে স্যাভলন, গজ ব্যান্ডেজ আর তুলো— এই তার ফার্স্ট-এইড বক্স। কয়েক মাস আগেই বক্সটি তৈরি করেছে। যদিও একদিনই মাত্র কাজে লেগেছিল এটি। তাও গত সপ্তাহে।
ক্লাসের ডানপিটে ছেলে রতন স্কুলে জুনিয়র একটি ছেলেকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিল। এতে ওই ছেলের পায়ের নখ উঠে যায়। কান্নাকাটি শুরু করা ছেলেটিকে ঘিরে অনেকেই দাঁড়িয়ে। খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে আকাশ তার পায়ে স্যাভলন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়।
এ ঘটনায় রতনকে খুব বকাঝকা করলেন হেডস্যার। একইসাথে স্কুলব্যাগে ফার্স্ট-এইড বক্স রাখায় আকাশের খুব প্রশংসাও করলেন তিনি। আনন্দে আকাশের মুখটা ঝলমল করে উঠেছিল সেদিন। আকাশের প্রশংসায় রতনের হিংসে হয়। এরপর থেকে রতন আর আকাশের সাথে কথা বলে না। রতন ডানপিটে হওয়ায় আকাশও আর মাথা ঘামায়নি।
তিনদিন পর স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আকাশ যেন বাতাসে ভর করে স্কুলে পৌঁছালো। ক্লাস শুরুর তখনও আধাঘণ্টা বাকী। তুষার আর শান্তি তখনও স্কুলে পৌঁছায়নি। আল আমিন এসেছে। ডানপিটে রতনটাও ক্লাসে বসা।
ক্লাসে ব্যাগ রেখেই আকাশ আর আল আমিন বাইরে বেরয়। তাদের অপেক্ষা, কখন তুষার আর শান্তি স্কুলে আসে! অবশ্য একটু টেনশনও কাজ করছে। তুষারটা আবার ফুটবল বাড়ি রেখে না আসে। এখন যদি একটু ফুটবল না খেলা যায়, তবে কখন খেলবে। অবশেষে তুষারটা আসলো। কিন্তু একই! ওর হাত তো খালি। বলটা আনেনি তাহলে? হতাশ হলো আকাশ। তখনই চোখে পড়লো শান্তির হাতে রয়েছে বলের ব্যাগটা। যাক তুষারটা তাহলে ভুল করেনি। এখন শুধু ছুটির ঘণ্টা পড়ার বাকী! শুনেই আল আমিন হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, ‘দোস্ত, এখনও তো ক্লাস শুরুই হয়নি, আর তুই ছুটির চিন্তা করছিস?’
বোকামি ঢাকতে আকাশ বুদ্ধিজীবীর মতো মাথা নেড়ে বললো, ‘শোন শুরুর আগেই শেষের চিন্তা করা ভালো, তাতে একটা পরিকল্পনা তৈরি হয়। ’
আল আমিন পাল্টা কিছু বলার আগেই ক্লাস শুরুর ঘণ্টা পড়ে গেল। টিচার এসে ক্লাসে ঢুকলেন। আকাশদের ক্লাসে তুষার, শান্তি, আল আমিন, রতনসহ মাত্র ১৪ জন ছাত্র এসেছে। ছাত্র কম বলে স্যার আর ক্লাসের বই পড়ালেন না। বৃষ্টির কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনালেন এবং গল্পের ছলে সে সম্পর্কে আলোচনা করলেন। খুব ভালো লাগলো ওদের। এভাবেই ৪টা ক্লাসের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেল।
ফুটবল নিয়ে মাঠে ছুটলো তারা। তুষার, শান্তি, আল আমিন, আকাশ, অমিত, মামুনসহ মাঠে ১১জন। ৫ জন করে দু’দলে ভাগ হলে একজন বেশি, আর ৬ জন করে ভাগ হলে একজন কম। এদিকে, রতন এসে তুষারকে ধরলো— ও খেলতে চায়। খেলোয়াড়ও একজন কম, অগত্যা রতনকেও দলে নেয়া হলো। প্রায় একঘণ্টা তুমুল খেলা। দু’দলে দুই দুই গোলে ড্র।
এমন সময় হঠাৎই বল নিয়ে ছুটতে গিয়ে পিছলে পড়লো রতন। তাড়াতাড়ি সবাই রতনকে ধরে তুললো। পায়ের চামড়া বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। আকাশ ছুটলো তার ফার্স্ট-এইড বক্স আনতে। কিন্তু একি, ব্যাগে তো বাক্সটা নেই! কী হলো! স্কুলে আসার সময় সে নিজ হাতে বাক্সটা ব্যাগে ভরেছে। তুষার রতনের পা চেপে ধরে আছে তবু রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। বাক্স না পাওয়ার কথা জানাতেই রতন চমকে উঠলো। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। কী করা যায়— ভাবছে সবাই। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া রতন জানালো, বাথরুমের পেছনে জঙ্গলের ভেতরে রয়েছে বক্সটা। শান্তি ছুটলো ওটা আনতে। বাক্সটা আনার পর স্যাভলন দিয়ে আকাশ কাটা জায়গা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করা হলো।
পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা হতেই সবাই রতনকে চেপে ধরলো, ‘বাক্সটা জঙ্গলের মধ্যে গেলো কী করে?’ চাপাচাপিতে কেঁদে ফেলে রতন। জানালো, সেদিন ওই বক্স নিয়ে হেডস্যার আকাশের প্রশংসা আর ওকে তিরষ্কার করায় তার রাগ হয়। তাই সে-ই নিয়ে বক্সটা ফেলে দিয়েছিল।
এরপর সে আকাশের হাত চেপে ধরে বললো— ‘দোস্ত, তুই আমাকে মাফ করে দে। যে বাক্স আমি ফেলে দিয়েছিলাম, সেটাই আজ আমার কাজে লাগলো!’
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১৪