ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন— অত্যন্ত দুষ্টু ছিলাম। স্কুলে দুষ্টু বালকদের সারিতে সবসময়ই প্রথম থাকতাম আমি।
বাসায় গিয়ে বাবাকে বলতাম। বাবা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন একই খেলনা আমাকেও কিনে দিতে, আর যদিও বা কোনোটির ব্যাপারে আপত্তি করতেন, অভিমানে বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম। এমনকি খাওয়া দাওয়াও বন্ধ করে বাসায় চুপটি মেরে বসে থাকতাম! শেষমেষ বাধ্য হয়ে কাঙ্ক্ষিত খেলনাবস্তুটি কিনে দিতেন আমায়।
আমরা তিন ভাইবোন। আমি সবার ছোট। মা আমাকে জন্ম দেওর সময় না ফেরার দেশে চলে যান। সে কারণে মায়ের আদর পাওয়া হয়নি। পেয়েছি দু’বোনের যথেষ্ট আহ্লাদভরা স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসা— সবটাই।
আমার আবদারের পরিমাণ এতো বেশি ছিল যে, মাঝেমাঝে বোনদেরও তাদের জমানো টাকা খরচ করে আবদার পূরণ করতে হতো। আমি তাদের একমাত্র ভাই! না করেই বা উপায় কী?
দুই
একবারের ঘটনা...
স্কুল থেকে বাসা বেশি দূরে না, তাই পায়ে হেটেই আসা যাওয়া করতাম। সেদিন হেলতে দুলতে স্কুলের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম স্কুলের সামনে একটা জটলা। ছেলে মেয়েরা সব কী একটা ঘিরে দাড়িয়ে আছে!
কৌতূহল বেড়ে গেল, দৌড়ে সেদিকে যেতেই দেখলাম সহপাঠী জসীম একটা নতুন সাইকেলের উপর বসে আছে! গতকাল জন্মদিন উপলক্ষে তার বাবা এটা তাকে কিনে দিয়েছে। সে আর স্কুলে পায়ে হেঁটে আসবে না, সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে আসবে!
ক্রমেই আমার আকর্ষণ বাড়তে লাগলো, আমি সবাইকে ঠেলে সামনে গিয়ে জসীমকে বললাম— ‘দেখি তো তোর সাইকেলটা কেমন!’
তার উত্তরেরও আর অপেক্ষা করলাম না। সোজা সাইকেলটা ধরতে গেলাম। ওমনি জসীম আমাকে জোরে ধাক্কা দিলো। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম!
জসীম তপ্ত মেজাজে বললো— ‘বাবা বলেছে, কাউকে ধরতে না দিতে! ধরলেই এটা নষ্ট হয়ে যাবে!’
আমি প্রচণ্ড রেগে গেলাম! ক্লাসে আমার গায়ে হাত তোলে এমন সাহস কারো ছিল না। আমি জসীমকে মারতে গেলাম। কিন্তু নতুন সাইকেলের কারণে সবাই জসীমের পক্ষে থাকায়, যথার্থ মারা গেল না!
রেগে এক পর্যায়ে বললাম— ‘যতদিন না আমি নতুন সাইকেল কিনবো, ততদিন আমি স্কুলে আসবো না! যদি আসি তাহলে আমি...’
অতিরিক্ত রাগের কারণে সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হয়নি, স্কুলগেট থেকেই ফিরে আসি বাসায়।
তিন.
আমাকে বাসায় ফিরতে দেখে আমার আদরের দু’বোন অবাক হলো। বুঝলো আমার মাথায় নতুন কোনো ভূত চেপেছে, ঘটনা কী জানতে চাইলে আমি কিছুই বললাম না। তারা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে, হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেদের কাজে মন দিলো।
রাতে বাবা বাসায় ফিরলে, তাকে বললাম— আমাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দিতে হবে। আমার কথা শুনে বাবা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তারপর আমাকে বোঝাতে লাগলেন, তার পক্ষে এখন একটা সাইকেল কিনে দেয়া অসম্ভব। তিনি একটা অত্যন্ত সাধারণ চাকরি করেন, বেতনের পুরো টাকা একসাথে করলেও একটা নতুন সাইকেল কেনা সম্ভব হবে না। এতো অল্প টাকায় সংসার যে কিভাবে চলে যায় তাই তিনি ভেবে অবাক হন... ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি অবুঝ! কিছুতেই বাবার কথা মানতে চাইলাম না, আমার সাইকেল চাই!!
অবশেষে বাবা কথা দিলেন আমি ক্লাস এইটে উঠলে তখন তিনি আমাকে একটা সুন্দর সাইকেল কিনে দেবেন।
সেই কথাতেও কোনো কাজ হলো না। আমার যেভাবেই হোক আমার কালকের মধ্যেই একটা সাইকেল চাই! কারণ আমি যদি কাল স্কুলে সাইকেল না নিয়ে যাই তাহলে আমার কথার কোনো মূল্যই থাকে না, থাকে না আমার ক্ষমতাও!
বাবার এক কথা— ‘অন্য কিছু নিতে পারো কিন্তু সাইকেল কিনে দিতে আমি এখন পারবো না!’
রাতের খাবার না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাতে সাইকেলের কষ্টে ঘুমাতে পারলাম না। কেঁদে-কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেললাম! শুধু একটি কথাই মনে হলো ঘুরেফিরে— এই বাসার কেউ আমাকে আদর করে না, কেউ আমার কথা ভাবে না, আর যদি আমাকে আদরই করতো তাহলে অবশ্যই সাইকেল কিনে দিতো! মায়ের কথাও মনে হলো—আজ যদি মা থাকতো তাহলে ঠিকই সে আমার কষ্ট বুঝতো, সাইকেলও কিনে দিতো!
চার.
পরদিন স্কুলে গেলাম না। সারাদিন ঝিম মেরে বাসায় বসে থেকে, বিকেলে প্রিয় বন্ধু রিয়াদের বাসায় গেলাম। রিয়াদের মা নেই আমারও মা নেই, তাই আমাদের মাঝে অন্য রকম একটা সম্পর্ক। রিয়াদকে কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনা বললাম, ও কিছুক্ষণ ভেবে আমাকে একটা দুষ্টু বুদ্ধি দিলো। ও বললো— আমি যেন আজ রাতটা ওদের বাসায় থেকে যাই, পরেরদিন সকালে বাবার অফিসে ফোন করে বাবাকে চেয়ে বলা হবে— আমাকে যদি একটা সাইকেল কিনে দেয় তবেই আমি বাসায় ফিরবো, আর যদি না কিনে দেয় তাহলে আমি আর কখনই বাসায় ফিরে যাবো না।
বুদ্ধিটা আমার খুব পছন্দ হলো, আবার ভয়ও হতে লাগলো! আগে কখনও একা একা বাসার বাইরে রাত কাটাইনি।
রিয়াদের বাসায় থেকে গেলাম। রাতে ঘুম এলো না, বার বার বাসার দিকে মন ছুটে গেল। অদ্ভুত সব চিন্তা আমাকে আকড়ে ধরলো, নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো।
সকালে ওর বড় ভাইকে দিয়ে বাবার অফিসে টেলিফোন করে জানতে পারলাম বাবা আজ অফিসে আসেননি!
আমার ভেতরে ধক করে উঠলো, যেন কোনো কিছুর সাথে আমি জোরে ধাক্কা খেয়েছি! আমি নিজেকে আর সেখানে ধরে রাখতে পারলাম না, বাসার উদ্দেশ্যে ছুট দিলাম।
না জানি বাবার কী হয়েছে! বাবা তো কখনো অফিস কামাই করেন না, এমন কি অসুস্থ হলেও না! তাহলে কি বাবা গুরতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন?
দৌড়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলাম কিন্তু কেউ দরজা খুললো না। আমি দরজা ধাক্কা দিয়ে গেলাম আর আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম!
পাঁচ.
দরজা খুলে শিউলী আপা রক্তবর্ণ চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, আমাকে প্রচণ্ড এক চড় দিলো, তারপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলো আর বলতে লাগলো—কোথায় গিয়েছিলি আমাদের না বলে? বল? বল কথায় গিয়েছিলি?
আমার আরেক বোন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে একই কথা বলতে লাগলো।
চড় খেয়ে কাঁদতে লাগলাম আমি, কারণ বোনদের হাতে মার খাওয়া দূরে থাকুক কখনো শক্ত বকাও খাইনি কখনো!
ক্রন্দনরত অবস্থাতেই আমাকে বাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।
বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন, তাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। আমার মনে হলো বাবা একদিনে অনেক রোগা হয়ে গেছেন! আমাকে দেখেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আনন্দভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন, পারলে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন! কাছে গিয়ে বসলাম, বাবা আমার হাতটা টেনে নিলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বাবার হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে, অনেকটা বৃদ্ধ লোকেদের মতন!
আস্তে আস্তে বাবা বললেন— কাল কোথায় ছিলি খোকা। আমি তোর জন্য তোর পছন্দের লাল রঙের সাইকেল কিনে এনে শুনি, তুই বিকেলের দিকে বেরিয়েছিস আর বাসায় ফিরিসনি।
কোথায় গিয়েছিলি? ওই দেখ তোর সেই সাইকেল, পছন্দ হয়েছে নাকি বল?
বাবা আমাকে ঘরের পশ্চিম পাশের দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আমি ঘুরে তাকাতেই দেখলাম একটি সুন্দর লাল রংয়ের সাইকেল দেয়ালে ঠেস দেয়া। জানালা গলে সূর্যের আলো এসে পড়ায় উজ্জ্বল লাল রং ঝিলিক দিচ্ছে!
কেন যেন এই অপরূপ সাইকেলের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ অনুভব করলাম না আমি! কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও যেটার জন্য গভীর টান ছিল, যেটার জন্য আমি বাসার সবাইকে ছেড়ে বাসার বাইরে রাত কাটিয়েছি, যেটার জন্য বাবা অসুস্থ হলেন, যেটার জন্য...
আমি বাবার দিকে তাকালাম— বাবা তোমার কী হয়েছে?
বাবা হাসলেন— তেমন কিছু না! এই তোমাকে না দেখে একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।
অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে থাকি আমি। বুঝতে পারি বাবার এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র আমিই দায়ী।
আর, মনে মনে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করতে থাকি এমন কাজ আমি আর কখনো করবো না যা আমার বাবা এবং আমার বোনদের কষ্ট দেয়।
বাবা আরো কী যেন বলতে থাকেন কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢোকে না। আমি শুধু অনুভব করি আমার ভিতরে কে যেন হু হু করে কাঁদছে।
ছয়.
পরদিন বাবা অফিসে চলে গেলে, আমি বড় আপাদের কাছে জানতে পারলাম। বাবা কাল রাত করে বাসায় সাইকেল কিনে ফিরে, যখন আমার বাসায় না আসার কথা শোনেন— তখন অজ্ঞান হয়ে যান! এবং এও জানতে পারি বাবা আমার জন্য যে সাইকেলটা কিনেছেন তা মায়ের রেখে যাওয়া গহনা বিক্রি করে!
এসব শুনে নিজের প্রতি আমার প্রবল ঘৃণা জন্মালো। একি করলাম আমি! যতদূর জানি মায়ের রেখে যাওয়া গহনাগুলো, নানান সময় নানান সমস্যার জন্য বাবা একটা একটা করে প্রায় সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শুধু একটা পাতলা গলার হার বাদে। সেটাই ছিল মায়ের রেখে যাওয়া শেষস্মৃতি! বহুদিন ধরে বাবা এ হারটা আগলে রেখেছেন, কঠিন বিপদেও বাবা এটা বিক্রি করা তো দূরে থাকুক এটার কথা ভুলেও মুখে আনতেন না! বাবা কেন তাহলে আমার এ ক্ষুদ্র পাগলামিকে এতো বড় করে দেখলেন!
আমার মনে আছে বাবা একবার শিউলি আপাকে খুব বকেছিলেন না বলে হারটা পরার জন্য!
আমি বুঝতে পারলাম আমি খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছি, আমার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন— অবশ্যই প্রয়োজন! চুপ করে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি আমি। বাবা বাসায় ফিরতে এখনো অনেক সময় বাকি!
বাংলাদেশ সময়: ২২১০ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৪