রনির হাতে বড় এক টুকরো ইট। চোখ চারধারে ঘুরে ঘুরে কাকে যেন খুঁজছে।
রাস্তায় নেমে বন্ধুদের খুঁজতে থাকে। কয়েকজন মিলে বিড়ালটাকে খুঁজলে কাজটা সহজ হবে। আজ ওটাকে খুঁজে বের করবেই। মনে মনে বলল রনি। পেলে ওটার ঠ্যাঙ ভেঙে দেবো। ওটাকে দু’চোখে দেখতে পারে না সে। অবশ্য এই পাজি বিড়ালটাকে দেখতে পারার কোনো কারণ নেই। এ পাড়ার লোকদের জ্বালিয়ে খাচ্ছে বিড়ালটা। রনিদের বাড়ির দিকে বেশি লোভ। দাদু তো রোজ অভিশাপ দেয় বিড়ালটাকে। সেই অভিশাপ মাথায় নিয়ে নবোদ্যমে ফিরে আসে সে। তবে বিড়ালটা মহা ধূর্ত, কেউ কখনও এটাকে ছুঁতেও পারে নি।
রাস্তাটা সোজা, দীর্ঘ আর একঘেঁয়ে। সোজাভাবে অনেকদূর চলে গেছে। দুপাশে এলোমেলো বাড়িঘর নিয়ে। ওদের এলাকাটা শহর থেকে বাইরে। শহরটা ক্রমশ বাড়ছে, ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। রাস্তায় নতুন ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। এই মধ্যদুপুরে কি হাস্যকরই না লাগছে ল্যাম্পপোস্টগুলিকে।
হঠাৎ হইচইয়ের শব্দ শোনা গেলো। অনেকগুলো বাচ্চা আর একটা লোক এদিকেই আসছে। লোকটা ঢ্যাঙ্গা আর মাথাভরতি কালো চুল। চারপাশে বাচ্চাগুলো থাকায় তাকে আরও লম্বা লাগছিলো। লোকটা এমনভাবে হাঁটছিল যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা, ভুলিয়ে ভালিয়ে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যাচ্ছিল গোপন গন্তব্যে। বাচ্চাগুলো আনন্দে লাফাচ্ছিল রনি দেখল ভিড়ের মধ্যে ওর কয়েকজন বন্ধুও আছে। ভিড়টা কাছে আসতে রনিও আনন্দে কলকল করে ওঠে। সেই বিড়ালটাই তো। বিড়ালের গলায় দড়ি বেঁধে লোকটা হিড়হিড় করে টানছে ওটাকে। ‘লোকটা বিড়ালটাকে ফাঁদ পেতে ধরেছে’ বন্ধুরা জানায় রনিকে।
‘লোভী বেড়ালের আজ শাস্তি হবে’ লোকটা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলে। ‘শাস্তি হবে, শাস্তি হবে’ বাচ্চাগুলিও আনন্দে সমস্বরে বলে ওঠে। রনি ভেবে পায় না বিড়ালটার কি শাস্তি হবে। সেও ওদের সাথে যেতে থাকে। বিড়ালটাকে যে সে এভাবে পেয়ে যাবে এটা সে ভাবেও নি।
ওদিকে বিড়ালটাকে দেখে মনে হচ্ছিল ঘাঘু চোর। হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল সারাক্ষণ। গলায় শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে দড়ি। সীমাহীন আতঙ্ক নিয়ে তাকাচ্ছিল আর দেখছিল চারপাশ। রনির এদিকেও তাকাল একবার। বিড়ালটাকে প্রায় হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল লোকটা। অবশেষে লোকটা একটা গাছের গোঁড়ায় থেমে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জিরোয়। চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেরা। ডান হাতে বিড়ালের গলার দড়ি ধরে লোকটা ছেলেদের দিকে তাকায়।
‘বলতো ছেলেরা ওকে আমরা কী শাস্তি দেব?’ ছেলেরা জানেনা , তাই তারা চুপ করে থাকে আর রুদ্ধশ্বাসে দেখে। ‘ওকে আমরা এই গাছের সঙ্গে ফাঁসি দেব। ‘অদ্ভুত জ্বলজ্বলে চোখে বলে লোকটা। দুপুরের রোদ তখন মাথার ওপর, আকাশে মেঘ উড়ছে, প্রচণ্ড গরম। সেই গরমে রোদ মাথায় নিয়ে ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে, এই প্রথম তারা সামনা-সামনি কোনো ফাঁসির আসামিকে দেখছে। কেমন নতজানু হয়ে বিড়ালটা পড়ে আছে। ধুলোবালি লেগে বিড়ালটা যেন এক ময়লার পোঁটলা। শুধু চোখ দুটো কি ভীষণ পরিষ্কার। লোকটা নিপুণ হাতে দড়িটা গাছে ঝুলিয়ে দেয়। বিড়ালটাও পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে আসে শূন্যে। হাত পা ভীষণভাবে ছুড়তে থাকে। গলার ফাঁস আরও শক্ত হয়ে এঁটে বসে। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বের হতে থাকে। হঠাৎ করেই যেন শব্দহীন হয়ে পড়ে চারদিক। ছেলেরা বিস্ফোরিত চোখে দেখে, বেড়ালটা মরে যাচ্ছে।
রনি হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওকে ছেড়ে দিন’। ও লোকটার সামনে এগিয়ে আসে। ওর গলার আওয়াজে কি যেন একটা উঠে আসে। সেটা অনুরোধের চেয়ে তীব্র, আদেশের চেয়ে বড়, ধমকের চেয়ে জোরালো। ওর মুষ্টিবদ্ধ হাত, উন্মত্ত কণ্ঠস্বর লোকটাকে কেমন যেন নিভিয়ে দেয়। খানিক আগের ছেলেদের সেই কৌতূহলী চোখে হঠাৎ কি যেন নতুন একটা ফুটে ওঠে। মনে হয় ওরা যেন ভুল বয়সী মানুষ। ওদের কাছে লোকটাকে অনেক ছোট আর ক্ষুদ্র দেখায়। লোকটা মিনমিনে গলায় বলে ‘কিন্তু ও লোভী’। ‘হোক লোভী তাও ওকে ছেড়ে দিন’ ছেলেরা সমস্বরে বলে ওঠে। ওরা হঠাৎ বুঝতে পারে খাবার চুরির জন্য কাউকে মেরে ফেলা যায় না। মধ্যদুপুরের মেঘমুক্ত আকাশ যেন অনেক ওপর থেকে অবাক হয়ে দেখতে থাকে ছোট্ট শরীরের অনেক বড় মাপের একদল মানুষকে।
এর অনেক দিন পরের কথা। মানুষ যেভাবে দত্তক নেয়, তেমনিভাবে অয়নও নিয়েছে বেড়ালটাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০১৪