নজরুলের যখন আট বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। এমনিতেই তাদের বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না।
নজরুলের বাবা দরগায় খাদেমের কাজ করতেন। পরে নজরুল নিজেই ইমামতি শুরু করেন। একে একে মক্তবে শিক্ষকতা, আসানসোলের কয়লাখনি-হোটেলে কাজ করে এবং যাত্রাগানের দল লেটোতে যোগ দিয়ে যে পয়সা রোজগার করতেন তাতে নজরুলের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হতো। জমি-জায়গা কিছুই ছিল না তাদের।
এসব কারণে কষ্ট ও দুঃখে পাওয়া সন্তান বলে ছোটবেলায় তার নাম রাখা হয়েছিল দুখু মিয়া। এই দুখু মিয়া কিন্তু বড় হয়ে আর দুখি থাকেননি। কবি হয়ে জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করলেন। তিনিই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।
আজ প্রেম, দ্রোহ, সাম্য ও জাগরণের এই কবির ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এ দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ৭৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তোমরা কখনো কবির লড়াই দেখেছ? না না! ঢাল-তলোয়ার বা রাইফেল নিয়ে লড়াই নয়। এ লড়াই কলমের। এ লড়াই ছন্দের। অনেক আগে গ্রামে গ্রামে এমন লড়াই হতো। এখনো যে হয় না তা নয়।
দুখি বলা হলেও ছোট থেকেই নজরুল ক্লীশে, জীর্ণ বা মেড়মেড়ে ছিলেন না। নজরুল ছিল খুবই দুরন্ত আর দারুণ দুষ্টু প্রকৃতির। এই দামাল ও ডানপিটে নজরুলই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বীরবিক্রমে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ‘লাথি মার ভাঙরে তালা’।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পেত না এমন লোক খুব কমই ছিল তখন। তাই বলে ভেবো না এই দলে নজরুলও ছিল। বরং সে-ই ছিল একমাত্র সাহসী ছেলে যে ব্রিটিশদের মুখের উপর বলে দিলো ‘ভারত ছাড়ো। ’
মাত্র বারো বছর বয়সেই এক বয়স্ক কবি ও পদ্যকারকে হারিয়ে দিলেন ছড়া ও ছন্দের লড়াইয়ে। সেই পদ্য লড়াইয়ের মেহফিলেই নজরুল তার সুন্দর সাহসের প্রমাণ রাখেন। নজরুল উচ্চারণ করলেন—
‘ওরে ছড়াদার, ওরে ‘দ্যাট’ পাল্লাদার
মস্তবড় ‘ম্যাড’
চেহারাটাও মানকি লাইক
দেখতে ভারী ‘ক্যাড’
‘মানকি’ লড়বে বাবরকা সাথ
ইয়ে বড় তাজ্জব বাত
জানে না ও ছোট্ট হলেও
হামভি ‘লায়ন ল্যাড’। ’
নজরুল যেখানেই যেতেন, ছোটদের নিয়ে আড্ডা জমাতেন। তাদের গল্প শোনাতেন। তাদের নিয়ে ছড়া কাটতেন। এসব ছড়ায় থাকতো মজার মজার কথা, মজার মজার গল্প-কাহিনী। তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোও কম বর্ণাঢ্য নয়। যেন গল্প-কাহিনী।
নজরুল যেমন বিদ্রোহী ছিলেন, তেমনি ছিলেন প্রেমের কবি। সে প্রেম প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য, ছোট্ট শিশুদের জন্য। শিশু সাহিত্য রচনায় নজরুল ছিল রীতিমত শিশুদের বন্ধু। ফলে নজরুলের ছড়া, কবিতা, গান, নাটিকা ছোট শিশু-কিশোরদের ভাবনায় উৎসারিত।
কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামের আলী আকবর খান ছিলেন কলকাতার স্কুল পাঠ্য বই-এর প্রকাশক ও একজন পুস্তক ব্যবসায়ী। নজরুলের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আকবর আলী নজরুলকে সেসময় শিশুদের ছড়া-কবিতা লিখে শোনাতেন। কিন্তু সেসব কিছুই হতো না বলে নজরুল নিজেই শিশুদের নিয়ে লিখবার জন্য ভাবতে শুরু করেন। এ সময়ই তিনি লিখলেন শিশুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় মনমাতানো কবিতা ‘লিচু চোর’।
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি...
কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সঙ্গেও এ সময়ই নজরুলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই পরিবারের ছেলে মেয়ে দুলি, বাচ্চি, জটি, লক্ষ্মী, বাচ্চু, রাখলু এদের সঙ্গে নজরুল একেবারে শিশুর মতোই। এ সময় দুলির পরিবারের ছেলে মেয়েদের খুশি করার জন্য নজরুল লেখেন মনভোলানো শিশু কবিতাগুলো। ‘ছোট খুকি’, ‘কাঠবিড়ালি, ‘মা খোকার গল্প বলা’, ‘খোকার বুদ্ধি’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতা এবং ঝিঙে ফুলের কিছু কবিতা নজরুলের দৌলতপুর কান্দিরপাড়ের জীবনেই লেখা। এছাড়া ঘুম-পাড়ানী মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো/বাটা ভরা পান দেবো গাল ভরে খেয়ো/ঘুম আয় রে, দুষ্ট খোকা ছুঁয়ে যা,/চোখের পাতা লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে যা,/ঘুম আয়রে, ঘুম আয় ঘুম—তার ব্যাপক জনপ্রিয় শিশুতোষ কবিতা।
দুলি পরিবারের বাচ্চি, লক্ষ্মী আর লাখলুদের নিয়ে মজাদার কবিতা লিখলেন—
লিখবে এবার লক্ষ্মী
নাম ‘জটায়ু পক্ষী’।
শিগগির আমি যাচ্ছি,
তুই দুলি আর বাচ্চি
রাখবি শিখে সব গান
নৈলে ঠেঙিয়ে অজ্ঞান।
............
এখনো কি বাচ্চু
খাচ্ছে জ্বরে খাপচু?
ভাঙেনি দুলির ঠ্যাংটা
রাখালু কি ন্যাংটা?
শুধু শিশুদের চঞ্চল মন মাতিয়ে রাখার পদ্যই লিখেননি নজরুল, শিশু-কিশোরদের মনে তাদের মতো করেই গভীর ভাব জাগিয়ে তোলারও চেষ্টা করেছেন— এমন মহান কারিগর।
নজরুল লিখলেন:
নতুন দিনের মানুষ তোরা
আয় শিশুরা আয়!
নতুন চোখে নতুন লোকের
নতুন ভরসায়।
নতুন তারায় বেভুল পথিক
আসলি ধরাতে
ধরার পার আনন্দ-লোক
দেখাস ইশারায়।
খেলার সুখে মাখলি তোরা
মাটির করুণা,
এই মাটিতে স্বর্গ রচিস,
তোদের মহিমায়।
কিংবা সবধরনের বাধা ও সীমা ভেঙে নজরুল রক্ততপ্ত কৈশোরকে বিশ্বজয়ের স্বপ্নময় আহবান জানাচ্ছেন এইভাবে—
রইব না-কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এসব ভুবন ঘুরে-
আকাশ-বাতাস-চন্দ্র-তারায় সাগর জলে পাহাড়-চূড়ে।
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটে;
পাতাল ফেড়ে নামব নিচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে;
বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৪