রাজু প্রায় মধ্যবয়স্ক মানুষ। মফস্বলের একটি গরিব পরিবারে জন্ম তার, কিন্তু পারিবারিক অভাব অনটন সত্ত্বেও বাবা-মায়ের চেষ্টায় বেশ ভালোভাবেই বেড়ে উঠে সে ।
তার বাবার একটি ঢালাইয়ের দোকান ছিল। সংসারের ভরণপোষণের জন্য তিনি দিনে বারো ঘণ্টারও বেশি কাজ করতেন সেখানে। এতো পরিশ্রমের পরও পরিবারকে সচ্ছলতার সাথে পরিচালনা করার মত যথেষ্ট রোজগার করতে পারতেন না তিনি ।
রাজু ছিল স্কুলের একজন গড়পড়তা মানের ছাত্র। পরীক্ষায় মোটামুটি মার্কস পেয়ে পাস করত সে। ছোটবেলায় রাজুর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়া। কিন্তু তার রেজাল্ট খুব ভালো ছিল না বলে সে পছন্দমতো বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেল না। সে একটি ব্যাচেলর ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হয়ে সফলতার সাথে তার পড়াশুনা শেষ করে। এরপর একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায় সে।
তার জীবন চলতে থাকে বৈচিত্র্যহীনভাবে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন ছাড়া। রাজুর বাবা তখনো সংসার চালানোর জন্য ঢালাইয়ের দোকানে সেই একই পরিশ্রমের কাজ করে যাচ্ছেন।
একটি স্থায়ী চাকরি পাওয়ার পর রাজুর বাবা-মা তাকে বিয়ে করাতে চাইল। রাজু বিয়ে করে পাশের শহরের একটি মেয়েকে। বিয়ের কিছুদিন পর চাকরিতে আরও পদোন্নতি পায় সে।
কয়েক বছর পর তাদের ফুটফুটে দুটি যমজ পুত্রশিশু হলো।
এদিকে রাজু আরও পদোন্নতি পেয়ে একটি সম্মানজনক বেতন পেতে শুরু করল। একই সঙ্গে তার চিন্তা চেতনাও পাল্টে গেল। জীবনযাপনে চলে এলো চরম বিলাসিতা ।
একটি নতুন বাড়ি কিনল, তারপর একটি গাড়ি। একজন অমিতব্যয়ীর মত বাড়াবাড়িরকম বিলাসিতা শুরু হয়ে গেল তার জীবনে। রাজু কোম্পানি থেকে গাড়ি পাওয়ার পরও একটি নতুন গাড়ি কিনল- এর কি কোন প্রয়োজন ছিল তার!
ছয় সাত বছর পর একসময় এই বিলাসবহুল জীবনযাপনের ব্যয়ভার বহন করা তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল । একদিকে ছেলেদের পড়াশুনা, অন্যদিকে সাংসারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচের হিসেবে রাজু দিশেহারা হয়ে পড়ল । কি করে জোগাবে এতো টাকা?
এদিকে তার বাবারও বয়স বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢালাইয়ের দোকানে কাজ করা অসম্ভব হয়ে যায় তার জন্য। তিনি চিকিৎসা ও পারিবারিক খরচাপাতি বাবদ রাজুর কাছে কিছু টাকা চাইলেন।
রাজু নিজেই তো তার এই ব্যয়বহুল জীবনে ইতোমধ্যে আর্থিক অনটনে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাবাকে সে টাকা দেবে কীভাবে? তাই বাবা যখন তার কাছে টাকা চাইতে এলো, রাজু বাবার উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে সাফ জানিয়ে দিল, সে কোন টাকাপয়সা দিতে পারবে না ।
রাজু তার বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য মা-বাবাকেই দায়ী করল।
সে বলল, ‘তোমরা আমাকে একটি ভালো স্কুলে পাঠাও নি। আমি ভালো কোন জামাকাপড় পরতে পারিনি। আমার পছন্দের খাবার খুব কমই দিয়েছ তোমরা।
তারপর আমি যখন কম মার্কস পেয়ে পরীক্ষায় পাস করতাম, তোমরা পড়াশুনায় উন্নতির জন্য বাড়তি টাকা খরচ করোনি। আর এভাবেই দশ বছরেরও অধিক সময় লেগে যায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে আমার। এখনো আমি টাকার জন্য যুদ্ধ করে চলছি। আমাকে সহযোগিতা করারও কোন ক্ষমতা নেই তোমাদের। তোমরা আমার কাছে একটি বোঝা ছাড়া কিচ্ছু না! আমার কাছে আর কক্ষনো আসবে না তোমরা । যাও!’
ছেলের আচরণে বাবা খুব কষ্ট পেয়ে চলে গেলেন ।
এক সপ্তাহ পর অফিসিয়াল ট্যুরে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে হয় রাজুকে । একদিন সন্ধ্যাবেলা কাজ শেষ করে ফেরার পথে একটি বাচ্চা ছেলের সাথে দেখা হয় রাজুর । ছেলেটির বয়স ১০ বছরেরও কম হবে। খেলনা বিক্রি করছিল সে। ছেলেটি তার কাছ থেকে কিছু খেলনা কেনার জন্য অনুরোধ করল রাজুকে।
রাজু ছেলেটিকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছেলে! তুমি খেলনা বিক্রি করছো কেন, তোমার বাব-মা কি করে?’
ছেলেটি উত্তর দিল, ‘এক বছর আগে বাবা অ্যাকসিডেন্টে হাত-পা হারান। তারপর থেকে তিনি কোন কাজকর্ম করতে পারেন না। মা গৃহকর্মী হিসেবে মানুষের বাসায় কয়েক ঘণ্টা কাজ করেন। কিন্তু মায়ের উপার্জনে সংসার চালাতে কষ্ট হয় । তাই খেলনা বিক্রি করে আমি বাবা-মাকে সাহায্য করছি।
রাজু বলল, তুমি স্কুলে যাও না?
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ। কাছেই একটি স্কুল আছে, আমি ওই স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ি। সকালে স্কুলে যাই, স্কুল থেকে ফিরে এসে সন্ধ্যায় খেলনা বিক্রি করি। তিন ঘণ্টা কাজ করি প্রতিদিন। রাতে পড়তে বসি।
রাজু ছেলেটির কাছে থেকে কিছু খেলনা কিনল এবং সে এই ছোট্ট ছেলেটির জীবন থেকে একটি বড় শিক্ষা পেল।
‘এইটুকুন বয়সে ছেলেটি তার মা-বাবাকে সাহায্য করছে, আর রাজু কিনা অমিতব্যয়ী জীবনযাপনের জন্য তার নিজের বাবা মাকে অবহেলা করল!’
বাংলাদেশ সময়: ২১৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪