(পূর্ব প্রকাশের পর)
- খবরদার। চুরি বলবি না হতচ্ছাড়া।
- তুমি পড়ো!!! চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো নান্টু।
- ‘হা হা হা হা হা, না রে বোকা। আমার নাতি-নাতনি আছে না। দাঁড়া। ’’
বলেই পাকুড় গাছটার মগডালের দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় হাঁক ছাড়লো। সুসমিতো, রবিতো। নড়ে উঠলো ওপরের ঘন পাতা। শন শন করে ঝড়ের মতো একটা শব্দ হলো। হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে নান্টু। মগডাল থেকে সড় সড় করে নেমে এলো তার বয়সী দুটো ছেলে মেয়ে। দু’জনের হাতে খাতা কলম আর সেই ছবিওয়ালা বইটা। এসে তারা বসলো বুড়ির পাশে। দেখতে বেশ সুন্দর। নাদুস নুদুস চেহারা। সুন্দর জামা কাপড় পরেছে। বেশ রঙচঙে জামা। নান্টুকে দেখে হাসি দিলো সুসমিতো আর রবিতো। নান্টুও সাহস ফিরে পেল কিছুটা ওদের দেখে। হাসি দিল।
আবার কথা বলে উঠলো বুড়িটা।
- এই যে। ওরা আমার নাতি-নাতনি। ওরাই পড়ে তোমার বই। ওদের শেখাচ্ছি কিছুটা পড়াশোনা। যা যুগ এসেছে বাপু। পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু চলে না। ভুতেরাও আজকাল পড়ে টড়ে। কলিকাল বলে কথা।
- তাহলে তুমি ওদের কিনে দিতে। আমারগুলো চুরি করো কেন। জানো না, চুরি করা অন্যায়।
- আহারে বাপু, হলো তো। আর চুরি করবো না। ভুল হয়ে গেছে। তোমার জিনিস তুমি নিয়ে যেও। ভুতেরা টাকা পাবে কোথায়। আমরা তো চাকরি-বাকরি করি না। তাই তোমার থেকে নিয়েছিলাম। নিয়ে যাও তোমার বই।
বলেই সুসমিতো আর রবিতোর হাত থেকে হ্যাঁচকা টানে বই খাতাগুলো কেড়ে নিয়ে নিচে ফেলে দিল বুড়ি। তারপর রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে নান্টু। ওদিকে ওপরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো সুসমিতো আর রবিতো। কান্না আর থামেই না। মায়া লাগলো নান্টুর। ওপরে তাকিয়ে বললো -সুসমিতো আর রবিতো। তোমরা আমার বন্ধু হবে?
হেসে ফেললো সুসমিতো আর রবিতো। দারুণ খুশি তারা। লাফিয়ে নেমে এলো উঁচু ডালটা থেকে। বই-খাতাগুলো নান্টু কুড়িয়ে ওদের হাতে দিল। তারপর গলা জড়াজড়ি করে কোরাস গাইতে লাগলো-
‘বন্ধু মোরা তিনজন
একটি মানুষ আর দুটি ভুতের বাচ্চা
থাকবো সবাই মিলে মিশে
পড়বো করে ভাগাভাগি,
খেলবো খেলা একসাথে। ’
ওপরে বুড়ি ভুতটা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো ওদের কাণ্ড দেখে। ভুতের বাচ্চা দুটো নাকি গলায় এটা সেটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে নান্টুকে। জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে নান্টু। তারপর ওদের আবদার নান্টুকেও উঠতে হবে মগডালে। কিন্তু নান্টু তো গাছে চড়তে জানে না। লাফিয়ে নেমে এলো বুড়ি। তিনজনকেই দু’হাতে জড়িয়ে সড়াৎ করে উঠে গেল মগডালে। তারপর ঝোলা থেকে প্যাকেট বের করলো একটা। কয়েকটা গুড়ের সন্দেশ। তারপর নান্টুকে হা করিয়ে খাইয়ে দিল একটা।
- হতচ্ছাড়া এই নে। আজ থেকে তুই ও আমার নাতি। প্রথমবার আসলে মিস্টিমুখ করে যা। আর শোন। আমাদের কথা কাউকে বলবি না। মানুষ খুব খারাপ। আমরা এখানে আছি জানতে পারলে গাছ কেটে নেবে। তখন আমরা কোথায় যাবো।
- কাউকে বলবো না দাদু।
- তুই আমাকে দাদু বলে ডাকলি। আয় বুকে আয়।
জড়িয়ে আদর করে দিল নান্টুকে। তারপর সুসমিতো আর রবিতোর কাছে বিদায় নিল। সুসমিতো রবিতোর মন খারাপ। বুদ্ধিটা করে দিল বুড়ি ভুতই। ওদের বললো- খেলতে চাইলে নান্টুর কাছে চলে যাবি। ওর বাড়ি চিনিয়ে দেবো। ও যখন একা থাকবে। সুড়ুত করে ঢুকে পড়বি ঘরে।
দাদুর বুদ্ধি বেশ পছন্দ হলো সুসমিতো আর রবিতোর। তারপর থেকে প্রায়ই মাঝরাতে পড়তে বসে নান্টু। কিন্তু অন্য ঘর থেকে তিনজনের পড়ার শব্দ পেতে থাকে সবাই। কিন্তু সামনে আসলে দেখে নান্টু একাই পড়ছে। বুঝতে পারে না কিছু। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নান্টুর দিকে। নান্টু টিফিনের টাকা জমিয়ে সুসমিতো আর রবিতোর জন্য ছড়ার বই, কমিকস কেনে। স্কুলে ক্লাসের সময় ওরা এসে ডালটায় বসে থাকে। নান্টুই দেখে শুধু, আর কেউ দেখতে পায় না ওদের। ওরা রসগোল্লা, সন্দেশ নিয়ে আসে নান্টুর জন্য।
অনেক দিন হলো নান্টু কিছু হারায় না। কিন্তু টিফিনের সময় নিজেই হারিয়ে যায় সে। টুপ করে পেছনের পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে যায় পাকুড় তলায়। তারপর বুড়ি ভুতটা এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় মগডালে। ওখানেই পুরো টিফিন পিরিয়ডটা খেলে, গান গায় সুসমিতো আর রবিতোর সাথে। ক্লাস টাইমে বুড়িই নামিয়ে দিয়ে যায় নিচে। প্রতিদিন টিফিনে নান্টু কোথায় যায় কেউ জানে না। খুঁজেও পায় না নান্টুকে। শেষ পর্যন্ত ও ফিরলে আবার সবাই মিলে কোরাস ধরে বন্ধুরা।
‘নান্টু আছে রে... নাই
নান্টু এখন- হারান্টু
নান্টু এখন হারান্টু। ’
নান্টু মুখ টিপে হাসে। এখন আর রাগ ওঠেনা বন্ধুদের জ্বালাতনে। সুসমিতো আর রবিতোই যে এখন তার ভালো বন্ধু। ওদের জন্য শুনলোই না হয় একটু কথা, অন্য বন্ধুদের কাছে। তাই কিছু বলে না। হেসে লুটোপুটি খায়। জানালার ওপাশে সুসমিতো আর রবিতোও হেসে গড়াগড়ি দেয় নান্টুর বন্ধুদের কাণ্ডকারখানায়।
(সমাপ্ত)
** হারান্টু | রকিবুল ইসলাম মুকুল
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৪