পূর্ব প্রকাশের পর
....গল্পে আমি মজা পাচ্ছি না জেনেও রিকশাওয়ালা গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামের মানুষের এটাই সমস্যা।
রিকশাওয়ালা চমকে উঠে বলল, ‘ভাইজান কি বলেন! ভূতের কথা তো কোরানেও আছে বলে শুনেছি। ’
আমি বললাম, ‘শোনেন। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞান এসব অযৌক্তিক বিষয় স্বীকার করে না। বিজ্ঞান খোঁজে বাস্তবতা। ’
আমার কথা মনে হয় তার কান পর্যন্ত পৌঁছলো না। সে নাক টানার মতো শব্দ করে বলল, ‘ভাইজান, আমার ছোটবেলার একটা গল্প আছে। ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প। আমি এক বাড়িতে কামলা থাকতাম। সেই বাড়িতে অনেকগুলো গরু ছিল। সেগুলো পাহারা দিতে রাতে আমাকে গোয়ালে থাকতে হতো। এক রাতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ’
রিকশাওয়ালা একটু বিরতি দিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলল, ‘ভাইজান, গল্পটা বলব?’
আমার আর উত্তর দিতে হলো না। সালামের দোকানে এসে গেছি। হারিকেনের স্বল্প আলোতে দোকানটা দেখতে পেলাম। সারা শরীরে একটা আলোড়ন বয়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকা প্রত্যেকটা মানুষেরই এমনটা হয়। নিজের গ্রামের ঘাসের উপর চোখ পড়তেই পুরো শরীর শীতল হয়ে যায়। আমি হাঁটুর ওপর থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে নামার প্রস্তুতি নিলাম।
রিকশাওয়ালা ততক্ষণে তার সিট থেকে নেমে আয়েশ করে মাটিতে দাঁড়িয়েছে। আমি পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে নিচু হলাম। হারিকেনের আলোতে দুইটা বিশ টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালার সামনে বাড়িয়ে বললাম, ‘চাচা টাকাটা নিন। ভাড়া তো বিশ টাকা, আরো বিশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম, এই রাতের বেলা আপনি অনেক উপকার করেছেন। ’
অনেকক্ষণ হাত বাড়িয়ে থাকার পরও রিকশাওয়ালা টাকা নিচ্ছে না দেখে ভালো করে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলাম। রিকশাওয়ালা নেই। বাড়ি ফেরার উত্তেজনায় এতক্ষণ খেয়ালই করিনি সেটা। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে কাউকে না দেখে জোরে হাঁক দিলাম, ‘চাচা, কোথায় গেলেন?’
কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাথায় কিছুই ঢুকল না, সেকেন্ডের মধ্যেই পালাল কোথায় লোকটা? হুট করে মনে হলো, হয়তো পাশেই কোথাও বাথরুম করতে বসেছে। রিকশাওয়ালারা এমনই। কিছুক্ষণ রিকশা চালিয়ে কোথাও থামলেই এদের বাথরুম পায়। আরো দুই মিনিট অপেক্ষা করেও রিকশাওয়ালাকে যখন পেলাম না তখন মাথায় এল, তার বাড়ি তো কাছেই, কাল সকালে বাড়ি গিয়েই টাকাটা দেয়া যাবে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই বের হলাম। মনছুর চাচাকে দ্রুত ধরতে হবে। টাকাটা দিয়ে কাল রাতের কাণ্ডটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে হবে।
দীর্ঘদিন বাইরে থেকে বাড়ি এসে রাস্তায় বেরুলেই এলাহি কাণ্ড হয়ে যায়। বন্ধুরা দৌড়ে আসে দেখা করতে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষ করতে করতে ঘড়িতে দেখি নয়টা বেজে গেছে। দ্রুত যাওয়া দরকার। রিকশাওয়ালারা সাধারণত এত বেলা পর্যন্ত বাড়িতে থাকে না।
প্রায় পনেরো মিনিট খোঁজার পর মনছুর চাচার বাড়ি পেয়ে গেলাম। বাড়ির সামনে কেউ নেই। কয়েকবার ডাকও দিলাম, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ এলো না। এবার গলায় হালকা শব্দ করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। উঠোনে আসার পর রান্নাঘর থেকে এক শুকনো-পাতলা মহিলা বেরিয়ে এলেন। অনুমান করতে ভুল হলো না ইনিই মনছুর চাচার বউ। মহিলা সামনে এসে দাঁড়াতেই বললাম, ‘চাচা কোথায়? কী কাণ্ড করেছে দেখেছেন! কাল রাতে রিকশা থেকে নামিয়ে ভাড়াটা না নিয়েই চলে এসেছে। ’
মহিলা প্রথমে বুঝতে পারল না কি বলবে। কতক্ষণ চোখওঠা রোগীর মতো তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুমি মনে হয় ভুল কইরা এখানে আইছো। তোমার চাচা তো বাড়িত নাই, মেলা দিন হইলো ঢাকায় থাহে। ঢাকার গুলিস্তানে রিকশা চালায়। ’
মহিলার কথা শুনে আমার ভেতর তোলপাড় শুরু হল। কোনো হিসাবই মেলাতে পারছি না। অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। কালকের লোকটা যে মনছুর কাকাই ছিল এটা আমি নিশ্চিত। তাহলে ভুলটা হলো কোথায়? কার রিকশা ছিল ওটা? রিকশা থেকে নামার পর লোকটা হারিয়েই বা গেল কেন?
আর ভাবতে পারলাম না। শরীর টলতে শুরু করছে। দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
প্রথম কিস্তি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৫