রবীন্দ্রনাথ, তোমার আমার রবীন্দ্রনাথ। আমাদের বিশ্বকবি।
তোমরা জেনে অবাক হবে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৫টি। এর মধ্যে রয়েছে বনফুল, কবি কাহিনী, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, শৈশব সঙ্গীত, এবং রুদ্রচণ্ড এর মতো আলোচিত বই। আর সমগ্র লেখালেখির জীবনে প্রকাশিত হয়েছে গান ও কাব্যনাটক বাদ দিয়ে ৬৫টি কবিতা বই। ছোটগল্প ১১৯টি। নাটক ৫০টি। ভ্রমণকাহিনী ৯টি। শিশুসাহিত্যের বই ৯টি। প্রবন্ধ-আলোচনা-ভাষণের বই ২০টি। এবং চিঠিপত্র কয়েক হাজার। এ সকল সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি এঁকেছেন ২ হাজারের মতো ছবি। বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ এই কবির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী অর্থাৎ জন্মের ১৫০তম বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর ২৫ বৈশাখ।
পারিবারিক পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনা শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় দিয়ে। সে সময় বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ থেকে ‘করখল’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ পড়ার সময় প্রথম কাব্যানুভূতি লাভ করেন তিনি। দুবছরের বড় ভাই সোমেন্দ্রনাথ, এক বছরের বড় ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ আর রবি একসঙ্গে সন্ধ্যায় পড়তে বসতেন। তাদের পড়াতেন গৃহশিক্ষক মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বড়দের দেখাদেখি স্কুলে যাওয়ার জন্য শিশু রবীন্দ্রনাথ একদিন কান্না জুড়ে দেন। গৃহশিক্ষক তার এমন কা- দেখে চড় মেরে কী বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন, ‘এখন স্কুলে যাইবার জন্য যেমন কাঁদিতেছ, না যাইবার জন্য ইহার চাইতে ঢের বেশি কাঁদিতে হইবে। ’ এ কথা কিন্তু পরে সত্যি হয়েছিল।
স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ তিনি মোটেও স্কুল কিংবা কলেজে যেতে চাইতেন না। স্কুল কলেজে যেতে চাইতেন না বলেই বাড়ির সকলে বিশেষ করে বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মা সারদা দেবী ছিলেন ভীষণ চিন্তিত। লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত করার অনেক চেষ্টা গুরুজনেরা করেছিলেন। কিন্তু ধরাবাঁধা লেখাপড়ার দিকে তার কোনো আগ্রহ ছিল না।
খুব কম বয়সেই তিনি পড়ে ফেলেন নীলমনি বসাক অনূদিত আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বেতালপঞ্চবিংশতি, ডেনিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো, মধুসূদন মুখোপাধ্যায় রচিত সুশীলার উপাখ্যান, মৎস্যনারীর কথা, উমাচরণ মিত্রের গোলেবকাওলি, হরিনাথ মজুমদারের লেখা বিজয় বসন্ত, হরিশ্চন্দ্র তর্কালঙ্কারের রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বোধোদয়, সীতার বনবাস, অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ, পদার্থবিদ্যা, সাতকড়ি দত্তের প্রাণীবৃত্তান্ত, লোহারাম শিরোরতের বাঙ্গালা ব্যাকরণ, হরিশ্চন্দ্র নিয়োগীর দুঃখ সঙ্গিনী, বিহারীলাল চক্রবর্তীর সারদামঙ্গল, সঞ্জিব চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মন্দ্রা, আষাঢ়ে, দীনেশচন্দ্র সেনের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র সিরাজদ্দৌলা, সরযুবালা দাশগুপ্তের বসন্ত প্রয়াণ- এর মতো আলোচিত বই।
এ সকল বই তিনি যখন পড়ছেন তখন পুরাদমে চলছে লেখালেখি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ নামের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার বনফুল নামক কাব্য উপন্যাস। তিনি প্রথম ইংল্যান্ড যান ১৭ বছর বয়সে।
রবি ঠাকুর এতো বড় পরিবারে জন্ম নিয়েও খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। তার ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময় কেটেছে গৃহকর্মী বা কাজের লোক আর শিক্ষকদের সঙ্গে। জমিদার বাড়ির সন্তান হয়েও তিনি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না। জীবনযাত্রার সবকিছুই ছিল নিয়ম-শৃঙ্খলার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। কাপড়-চোপড়ও ছিল কম। বাড়ির সবার জামাকাপড় তৈরি করতেন এক খলিফা। তার নাম নেয়ামত। রবীন্দ্রনাথ খলিফাকে বলতেন তার জামায় যেন কোনো পকেট রাখা না হয়। কারণ তিনি মনে করতেন জামার পকেট মানেই তো নিজের কাছে টাকাপয়সা রাখার ইচ্ছে হওয়া। শুধু কী তাই। দশ বছর বয়সের আগে তিনি কখনোই মোজা পারেননি। আর শীতকালে কোনো গরম কাপড় নয়। একটি সাদা জামার ওপর আরেকটি সাদা জামা পরতেন। উল কিংবা পশমী গরম কাপড় পরতেন না।
ঠাকুর বাড়িতে গৃহকর্মীর অভাব ছিল না। রবীন্দ্রনাথের দিন কাটতো গৃহকর্মীদের শাসনে। তার মধ্যে একজনের নাম ছিল শ্যাম। শ্যাম শিশু রবিকে একটি ঘরে ঢুকাতো। তারপর ঘরের চারদিকে চক দিয়ে দাগ কেটে দিতো। এরপর মুখ গম্ভীর করে বলতো, গণ্ডির বাইরে গেলে ভীষণ বিপদ। বিপদের কথা শুনে রবি ঐ গণ্ডির মধ্যে চুপ করে বসে থাকতেন। আর জানালা দিয়ে আকাশ, পাশের ঘাট বাঁধানো পুকুর, চীনাবউ, বাড়ির দক্ষিণ দিকে নারিকেল গাছের সারি দেখতেন। এসব দেখতে দেখতে শিশু রবীন্দ্রনাথের মন ভেসে যেত কল্পনার রাজ্যে। যে কল্পনা তাকে লেখক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।
ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ মেনে চলতেন নানা ধরনের স্বাস্থবিধি। আর এ কারণেই বেধহয় তিনি সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। অথচ তিনি তার এক লেখায় বলেছেন, মানুষের জীবনে অবসরটাই বড়। ঘরের দেয়ালের মতো অবসরের চারপাশ কাজ দিয়ে ঘিরে রাখতে হয়। তারপর ঘরের মাঝখানের ফাঁকা জায়গার মতো অবসর উপভোগ করতে হয়। এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের অবসরটুকুও কাজ দিয়ে ভরাট করে গেছেন।