জানালার শিক গলিয়ে চাঁদের আলো গায়ে এসে পড়েছে। সিঙ্গেল বেডে হাত-পা ছড়িয়ে সটান হয়ে শুয়ে আমি।
শহুরে ব্যস্ত গলির মাথায় মিশনারি অরফান হোমসের বিছানায় শুয়ে ১৪ বছরের জীবনে প্রায় অনেক রাতেই চাঁদ, মোমবাতির আলো আর জানালার গরাদের দিকে তাকিয়ে এলোপাথাড়ি ভাবনায় সাঁতরে বেড়িয়েছি আমি।
গির্জার ঘড়িটা মাত্র রাতের শেষ ঘণ্টার জানান দিলো। সিস্টার জোসেফিন মেরির ঘরে আলো জ্বলছে। একটু পরেই রাউন্ড দিতে আসবেন তিনি। এ ঘরের আলো নেভানো। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার ঘুম আসছে না। সিস্টার জোসেফিন বলেছেন, ঘুম না এলে ১০ থেকে উল্টো এক পর্যন্ত গুণতে। তাতেও যদি কাজ না হয় তবে একশো থেকে এক পর্যন্ত গুনতে। ঘুম আসবে।
সেই চেষ্টায় চোখ বন্ধ করলাম। চোখের মনি চোখের পাতা বরাবর। ১০ থেকে এক পর্যন্ত গুণে আসতেই নিজের অজান্তেই আমার মন বলে উঠলো, আরাম...আরাম...আরাম। অার আমি সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে গেলাম আলফা স্টেশনে।
আলফা স্টেশন থেকে সবে পা বাড়িয়েছি। নরম তুলতুলে পা দুটো স্পর্শ করলো বৃষ্টিতে ভেজা মাটি। সামনে রাস্তার ইটের গাঁথুনির ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সদ্য জন্ম নেওয়া কচি ঘাসগুলো। বৃষ্টি যেন ধুয়ে মুছে প্রকৃতিকে নতুন করে তুলেছে। মেঘলা আকাশ, মিষ্টি ঠাণ্ডা বাতাসটা যেন আমার মন থেকে সব এলোপাথাড়ি ভাবনা মুছে দিয়ে গেলো। আমি কে, আমার বাবা-মা, পরিবার-পরিজন, অতীত আর ভবিষ্যত নিয়ে অহেতুক কোনো প্রশ্নই আমাকে ক্ষান্ত করতে পারলো না।
আমি এখন পা বাড়াবো মনের বাড়ির পথে। একটা স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখবো বলে আমি এগোচ্ছি। খালি পায়ে দু’হাত মেলে ছুটে চলছি স্বপ্ন ছোঁবো বলে। মেঘের মতো আমার চুলগুলোও যেনো আজ ডানা মেলে উড়ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা স্বাধীন পায়রা। বৃষ্টির প্রতিটা বিন্দু আমার শরীরের প্রতিটা কোষে কেমন উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে।
পথের শেষে ছোট্ট একটা সবুজ বাড়ি চোখে পড়লো। কাঁচা বাঁশের বাড়িটার পেছনের ক্যাথলিক গির্জার ছাদের বিশাল ক্রুশটার খানিক অংশ দেখা যাচ্ছে। দূরের রাস্তায় সাদা শাড়ি পরে সিস্টাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। মেঘলা নীলাভ আলোতে তাদের দেখতে দেবদূতের মতো লাগছে।
আলতো করে বাড়ির ভেজানো দরজায় হাত রাখলাম। না, ভুল করিনি। এটা আমারই মনের বাড়ি! এই যে বেগুনি অর্কিড ফুল, মানিপ্ল্যান্টস, ঝলসে যাওয়া সুগন্ধি মোমবাতির গন্ধ, তুলোর বিছানা সব আমার। এখানে হারানোর নেই কিছুই। আজ আমিও হারিয়ে যাবো না দুর্বোধ্য ভাবনার অন্ধকার স্যাঁতস্যাতে মৃত্যুকূপে।
আমি জানি, এই ঘরটির ভেতরে শুধু আশ্রয় নয়, আছে আমার নিজের পরিচয়। ঘরে পা রাখতেই প্রশান্তি আর ভালোলাগায় মন ভরে গেলো। মোমবাতির আলোগুলোও যেনো আজ কথা বলছে আমার সঙ্গে।
পেছন ফিরতেই চোখ পড়লো স্বচ্ছ আয়নায়। ইস্, আয়নাটা যেন হিরের টুকরো দিয়ে বানানো। কিন্তু, আয়নায় এ কাকে দেখছি আমি! ধবধবে সাদা গাউন পরা এক রাজকুমারী। এলোমেলো লালচে-কালো চুলগুলো দু’পাশে ঝোলানো। শান্ত দু’টি চোখ। তবে চোখ দুটো কি যেনো বলতে চাইছে। ঠিক আমার চোখের মতোই। মুখে অপার বিস্ময়। ঠোঁটটা খুব পরিচিত লাগছে আমার। ভীষণ লোভ হচ্ছে ওই ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মিষ্টি হাসিটার প্রতি। রসালো হাসির প্রতিটা ফোঁটা যেন চোঁয়াল বেয়ে বেয়ে পড়ছে। হঠাৎ গির্জার ঘণ্টার ভারী শব্দে আয়ানাটা খণ্ড খণ্ড হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। আমার পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো। এরপর?
শূন্য.. এক .. দুই.. তিন.. চার.. পাঁচ.. ছয়.. সাত...। লম্বা দম নিয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম। জানালাটা বন্ধ। ঘড়িতে রাত একটা। কোরিডোর দিয়ে সাদা শাড়ি পরা দু’জন সিস্টার পাশের ঘরে গেলেন।
বিছানা থেকে নেমে স্নানঘরের আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। দেখতে পেলাম সাদা জামা পরা এক রাজকুমারী। এলোমেলো লালচে-কালো চুলগুলো দু’পাশে ঝোলানো। চোখ দুটো ফেটে যেনো কথা বেড়িয়ে আসছে। ঠোঁটটাও খুব পরিচিত লাগছে। মরিচা ধরা সেই ঠোঁট।
একবারও হাসতে পারলাম না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৫
এএ