ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

শুনতে কি পাও বাংলাদেশ!

জাহিদ নেওয়াজ খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১১
শুনতে কি পাও বাংলাদেশ!

নওশিনের কথা মনে আছে? বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স হতো ১১। নওশিন বেঁচে নেই, তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলো না।

বিশ মাস বয়সে তার চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া, কিন্তু কোনো অসুখ অথবা সড়ক বা নৌ দুর্ঘটনায় না; যে দুর্ঘটনা বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী। পুরো বাংলাদেশকে অপরাধী করে নওশিনের মৃত্যু হয়েছে বুলেটে।

চরম লজ্জার আর নির্মম ওই ঘটনাটি ঘটেছে ২০০২ সালের ৯ মে। রামপুরা এলাকা দিয়ে বাবার সঙ্গে রিকশায় যাচ্ছিলো নওশিন। হঠাৎ ছিনতাইকারীদের গুলি, তারপর পুরো জাতিকে রক্তাক্ত করে শিশু নওশিনের মৃত্যু।

নওশিনের মৃত্যুতে বাংলাদেশ তখন আরো বেশি লজ্জিত হয় সেসময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এক অবসরপ্রাপ্ত এয়ারভাইস মার্শালের কান্ডজ্ঞানহীন কথায়। শিশুটির মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আল্লাহর মাল’ আল্লাহ নিয়ে গেছেন। তার এমন কথায় পরে আলতাফ হোসেন চৌধুরীর নিজের নামই হয়ে যায় ‘আল্লাহর মাল’। তবে মাঝখানে ওয়ান ইলেভেনের ঝড় আর বর্তমান আমলে একবার হরতাল ঝাপটার পর বহাল তবিয়তেই আছেন ‘আল্লাহর মাল’ তত্ত্বের উদগাতা আলতাফ চৌধুরী।

একথা ঠিক যে আলতাফ হোসেন চৌধুরী অন্য অনেকের মতো শুধু সান্ত্বনা দিতেই ওই শব্দ দুটি উচ্চারণ করেছিলেন। তার নিজেরও এমন প্রিয়জন হারানোর কষ্ট আছে। তবে ব্যক্তি হিসেবে এমন কথা বলা, আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মানুষের জানমালের দায়িত্ব নিয়ে সেই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার পর ওই কথা বলার মধ্যে পার্থক্য আকাশপাতাল। জীবনের প্রায় পুরো সময়ই ছাউনিতে থাকার কারণেই হয়তো মানুষের সবচেয়ে বড় যে জ্ঞান, ‘কান্ডজ্ঞান’ তা মাথা থেকে নীচে নেমে গিয়েছিলো তার। সে কারণেই হয়তো সেদিন তিনি বুঝতে পারেননি মন্ত্রী হিসেবে তার কি বলা উচিত, আর কি বলা উচিত নয়।

নওশিনের মৃত্যু সেসময়ের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির এক বড় প্রমাণ। তার সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন দায়িত্বহীন কথা! পুরো বাংলাদেশ তখন তার কথা ও কাজে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে যে রাশি রাশি অভিযোগ তুলে সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে তার একটি ছিলো শিশু নওশিনের মৃত্যু।

২.
নওশিনের কথা যাদের মনে আছে তাদের নিশ্চয়ই সেসময় আওয়ামী লীগের সংসদে যোগ দেওয়ার দিনটির কথাও মনে আছে। সেদিন ছিলো ২৪ জুন, ২০০২। এর আগের বছর ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনের পর ওইদিনই প্রথমবারের মতো সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

আগে থেকেই খবর ছিলো ২৪ জুন অধিবেশনে যোগ দিচ্ছে প্রধান বিরোধীদল। মানুষ প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে তাদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অনেক সাধারণ মানুষ সেদিন ল্যুই কানের অসাধারণ স্থাপত্য সংসদ ভবনের চারপাশে ভিড় করেন। অধিবেশনকক্ষের ভিআইপি গ্যালারিসহ সবকটি গ্যালারি ছিলো কানায় কানায় ভরা। অনেক মানুষ গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে থেকে বিরোধীদলের সংসদে যোগদানদৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। সংসদ ভবনে ঢুকতে গিয়ে সাংবাদিকসহ সকলকে বাড়তি নিরাপত্তা তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। একাধিকবার পরীক্ষা করা হয় সংসদ ভবনে প্রবেশের অনুমতি পাস। মূল ফটকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। লিফটের সামনেও পড়ে যায় দীর্ঘ লাইন।

অধিবেশনে যোগ দেয়ার আগে বিরোধীদলের সভাকক্ষে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় যোগ দেন আওয়ামী লীগের ৫৭ জন সংসদ সদস্য। ৬টা ৩৫ মিনিটে সভা শুরু হয়ে শেষ হয় ৭টা ২ মিনিটে। বৈঠক শেষে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে সংসদ অধিবেশনে অংশ নিতে যাচ্ছি। দেশব্যাপী যে হত্যা-ধর্ষণ-সন্ত্রাস এবং বিরোধীদলের ওপর যে রাজনৈতিক নির্যাতন চলছে তার প্রতিবাদ জানাতেই আমাদের সংসদে যোগদান। ’

এরপর মাগরিবের নামাজ শেষ করে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। কোরআন তেলাওয়াত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিরো আওয়ারে বক্তৃতা করতে দাঁড়ান বিরোধীদলীয় নেতা। পনেরো মিনিটের বক্তৃতায় তিনি বলেন, `জাতির সামনে আজ চরম দুর্যোগ। দেশে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি, শিশুকন্যা থেকে বৃদ্ধা ধর্ষণ, বাবার কোলে সন্তান হত্যা কী না ঘটছে? ওইসব নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ সরকারের উচ্চ শিখরে যারা বসে আছেন তাদের কানে পৌঁছে না। আমরা তাদের কথা বলতে সংসদে এসেছি। `

২০০১ এর ১ অক্টোবর থেকে ওইসময় পর্যন্ত তার দল এবং সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, `বাবার কোলেও আজ শিশুসন্তান নিরাপদ নয়, আল্লাহর দোহাই দিয়ে মানুষকে লিল্লায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। `

বক্তৃতার পর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর থেকে নিহত মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১ মিনিট নীরবতা পালনের প্রস্তাব করেন শেখ হাসিনা। স্পিকার তা নাকচ করলে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা নিজেরাই নীরবতা পালন করেন। সেসময় তারা আগে থেকে নিয়ে যাওয়া বড় বড় খাম খুলে একেকজন একেকটি ছবি প্রদর্শন করেন। শেখ হাসিনার হাতে ছিলো রিকশায় যাওয়ার সময় বাবার কোলে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত শিশু নওশিনের ছবি।

৩.
নওশিনকে নিয়ে জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার মর্মস্পর্শী বক্তৃতার ঠিক ৯ বছর ১ সপ্তাহ পর একইরকম ঘটনা দেখলো বাংলাদেশ। এবার নির্মমতার শিকার ৪ বছরের শিশু নুহা। স্কুলে যাওয়া ছাড়াও এই বয়সেই নাচতে শিখেছিলো সে, ছবি আঁকতো। তার কথার মালায় মুগ্ধ হতো সবাই। কক্সবাজারের পাহাড় আর সমুদ্র খুব প্রিয় ছিলো নুহার। এর আগে চারবার কক্সবাজার ঘুরে এসেছিলো। একমাত্র মেয়ের আবারো কক্সবাজার যাওয়ার ইচ্ছা পূরণে ৩০ জুন ঢাকা থেকে রওনা হন নুহার মা-বাবা, সঙ্গে তাদের বন্ধুরা। রাত তখন ৩টা, চকোরিয়া পার হচ্ছে গাড়ি। বাবার বুকে ঘুমিয়ে নুহা, তখনই সেই মর্মান্তিক ঘটনা।

রাস্তায় ডালপালা ফেলে রেখেছিলো ডাকাতরা। তবে ওই বাধা পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব মনে করে নুহার বাবা ড্রাইভারকে গাড়ি চালিয়ে যেতে বলেন। বাধা পেরিয়েও যাচ্ছিলো গাড়ি। ঠিক তখনই ডাকাতদের গুলি। একটি গুলি লাগে নুহার বাবার বাম হাতে। কিন্তু নিজের ব্যথা ভুলে হঠাৎই নুহার বাবার মনে হয় গুলির শব্দ আর এতো হই-চইয়ের পরও তার কোলে নুহার কোনো সাড়া নেই কেনো? তাকিয়ে দেখেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে নুহার কপাল, মুখ; একচোখে তাকিয়ে খুব কষ্টে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে নুহা। বাবা চীৎকার করে বলছেন, তোমার প্রিয় কক্সবাজার দেখবে না মা? কিন্তু নুহার কোনো সাড়া নেই। শুধু খুব কষ্টে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা। এরপর কক্সবাজার হাসপাতালে চিরদিনের জন্য নুহার চলে যাওয়া চিরঘুমের দেশে।

নুহার বাবা প্রকৌশলী জহিরুল হক তরুণের পরিবারের প্রায় সকলেই বিদেশে থাকেন। মেধার গুণে তারও যোগ্যতা ছিলো বিদেশে চলে যাওয়ার। কিন্তু তরুণ যাননি। দেশেই থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। এখন তার স্বজনরা বলছেন, দেশ তোকে কি দিয়েছে? তরুণকে তরুণ বয়সে শিশু সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে মাটির বুকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়েছে ৪ বছরের সাবরিয়া রাইসা নুহাকে।

৪.
নুহার মৃত্যু প্রায় অজানাই থেকে যাচ্ছিলো বাংলাদেশের। কোনো গণমাধ্যম, কোনো সাংবাদিক জানতে পারেননি ১ জুলাই ডাকাতের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বাবার কোলে ঘুমিয়ে থাকা ৪ বছরের এক শিশুর। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুক এবং এরপর একটি দৈনিকের চিঠিপত্র কলামে প্রকাশ পায় নুহার মৃত্যু আর তার মা-বাবার কষ্টের কথা।

এরপরও গণমাধ্যম যে বিষয়টি খুব বেশি সামনে এনেছে এমন নয়। এমনকি নুহার সহপাঠী শিশুরা প্ল্যাকার্ডে তাদের কষ্টের কথা বলে তাদের বন্ধুর জন্য যে মানববন্ধন করেছে তাও না। পৃথিবীতে এমন আর কটি ঘটনা আছে যেখানে ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, তাদের যে বন্ধু চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে, যে বন্ধু আর কখনোই তাদের সঙ্গে খেলতে আসবে না, সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর জন্য তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। গণমাধ্যমের কাছে যদি এর সংবাদমূল্য না থাকে তাহলে বুঝতে হবে বিবেক হারিয়েছে ওই গণমাধ্যম। অথবা তাদের বিবেক কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কাছে বন্দি।

আর নুহার মৃত্যুর পর সরকারের নীরবতায় আরেকবার প্রমাণ হলো বাংলাদেশের রাজনীতি আর রাষ্ট্রনায়কদের কাছে ক্ষমতাই সবকিছু। শিশু নওশিন যখন নিহত হয় তখন বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে অনেক মমতা আর বিবেকের সঙ্গে ওই ঘটনা জাতীয় সংসদে তুলে ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। আল্লাহর দোহাই দিয়ে মানুষকে লিল্লাহ ছেড়ে দেয়ার কথা বলার কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। অথচ আজ তিনি ক্ষমতায়, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নুহার বিষয়ে একেবারেই নীরব। আর যে নওশিনের ছবি শেখ হাসিনা সংসদে দেখিয়েছিলেন, তার দল ক্ষমতায় যাওয়ার পর ওই হত্যাকান্ডের বিচারে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন কোনো খবরও জানা নেই।

বারবারই প্রমাণ হয়েছে এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা অমানবিক, ক্ষমতাবানরা মানুষ থেকে অনেক দূরে। নওশিন বা নুহাদের মৃত্যু তাই বারবারই ক্ষমতার রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে যায়। তবে মানুষও আছে অনেক এদেশে। নুহার মা-বাবার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের বন্ধুরা। শুধু বন্ধুর পাশে নয়, সব নাগরিকের নিরাপত্তার দাবিতে নাগরিক নিরাপত্তা ফোরাম নামে সংগঠনও করেছেন তারা। এরইমধ্যে তারা ফেইসবুকে ‘ইউনাইট ফর নুহাস সেইক, ইউনাইট এগেইনস্ট ক্রাইম’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন।

নুহার জন্য এখন এক হওয়া মানে, আর কোনো নুহা ট্র্যাজেডি যেনো না ঘটে; আর যেনো অমন নির্মমতার বিচার চাইতে না হয় সেই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা। সেই নিশ্চয়তা কি তারা দেবেন যারা নওশিন-নুহাদের তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি মনে করেন?

যাদের নওশিনের কথা মনে আছে তাদের নিশ্চয়ই ৯ বছর আগে নওশিনের মা-বাবার প্রশ্নটিও মনে আছে। আজ নুহার মা-বাবারও সেই একই প্রশ্ন: কি দোষ ছিলো তাদের ছোট্ট মেয়েটার?

আর যাদের নওশিনের কথা মনে আছে তাদের নিশ্চয়ই নওশিনের ছবি হাতে শেখ হাসিনার ওই বক্তৃতার কথাও মনে আছে যেখানে তিনি বলেছিলেন, `নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ সরকারের উচ্চ শিখরে যারা বসে আছেন তাদের কানে পৌঁছে না। ` তিনি কি আজ শুনতে পাচ্ছেন না নুহার মা-বাবার কান্না?

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।