ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

চাঁদের বুড়ি ও সিডরের গল্প

মাহমুদ মেনন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১১
চাঁদের বুড়ি ও সিডরের গল্প

আকাশের পেঁজা পেঁজা তুলো কুড়িয়ে বুড়ি যখন চাঁদে ফিরছিলো তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। একেতো তুলোর বোঝা, তায় আবার উঁচু নিচু পথ।

ভারি কষ্টই হচ্ছিলো বুড়ির।

শরতের সাদা আকাশ পেয়ে তাজা তুলো একটু বেশিই কুঁড়িয়ে ফেলেছে সে।

সবসময় তো আর এমন দুধসাদা বড় বড় তুলোর কুণ্ডলি পাওয়া যায় না। প্রায়ই কেমন ছাড়া ছাড়া তুলো মেলে- তা দিয়ে ভালো সুতাকাটা যায় না। চরকায় তুললেই ছিঁড়ে যায়। আবার সুতো হলেও তার টিকটা ঠিক শক্ত হয় না।

এই এক জ্বালা। চরকা কাটতে গিয়ে সুতো ছিঁড়ে গেলে বুড়ির মেজাজ চড়ে। তাই ভালো তুলো মানে ভালো সুতো আর ভালো সুতোয় ভালো চরকা কাটা... খুশি খুশি লাগে বুড়ির।

এদিকে যে সূর্য অস্ত যাচ্ছে সে খেয়ালই নেই। ভালো তুলোর টানে পশ্চিম আকাশে একটু বেশিই এগিয়ে গিয়েছিলো বুড়ি। তাই এবার তার জোরে জোরে হাঁটা। পূব আকাশে উঁকি দেওয়ার আগে চাঁদে পৌঁছা বেশ কষ্টসাধ্যই হবে ভাবছিলো বুড়ি।

লাঠিতে ঠকঠক শব্দ তুলে বুড়ি যখন তড়িঘড়ি হাঁটছিলো তখন পূবালী বাতাস যাচ্ছিলো সে পথে।

বুড়িকে তাড়াহুড়ো করতে দেখে বললো, আরে বুড়ি করো কি? এই বয়সে এত জোরে হাঁটা কিন্তু মোটেই ঠিক হচ্ছে না। একে তো পুরো কুঁজো হয়েছো, তায় আবার কোমড়ে বাত। এ অবস্থায় মাজা ভেঙ্গে পড়লে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।

রাখো তোমার কেলেঙ্কারি, চাঁদ উঠলো বলো। এখন কোমর নিয়ে ভাবলে আজ আর ডেরায় ফেরা হবে না।

কাল পূর্ণিমা। পেঁজা তুলো পেয়ে খুব ভালো হলো মনে মনে ভাবছে বুড়ি। পৃথিবীটাকে কাল মনের মতো করে আলোকিত করে তোলা যাবে। ভাবতে ভাবতে আরেকটু জোরে পা চালালো।  

বুড়ি ডেরায় যখন পৌঁছলো তখন সুর্যের আলো চাঁদের গায়ে পড়ি পড়ি করছে।

এই এক অদ্ভুত ব্যাপার। সুর্যের এই আলোটা বুড়ির জন্য সবচেয়ে কাজের হলেও ওটাকে গায়ে লাগাতে তার বড়ই আপত্তি। আর সেকারণেই তড়িঘড়ি করে ঢুকে পড়লো ডেরায়।

খানিকটা বিশ্রাম নিয়েই আবার উঠে পড়লো বুড়ি। পূবালী বাতাস আবারও যাচ্ছে সে পথে। বললো, কি বুড়ি আবার উঠলে যে...
না উঠে কি আর জো আছে... কাল পূর্ণিমা। তোমরা বারবার দেখি সে কথাটাই ভুলে যাও! মুখ ঝামটালো বুড়ি।

কাল পূর্ণিমা। তাই আজ চাঁদের বুড়ির অনেক কাজ। তাকে চাদর বুনতে হবে। সে চাদর গোটা চাঁদ জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। সে সাদা চাদরে সূর্যের আলো ঠিকরে গিয়ে পড়বে পৃথিবীতে, তাতে আলোকিত হবে পৃথিবী। আর সে আলোয় খুশি হবে পৃথিবীর মানুষ। হাসবে, গাইবে।

‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। ’ গাইতে গাইতে একটু যেন টোল পড়লো বুড়ির গালে, মুখও হয়ে ওঠলো লজ্জারাঙা।

রাতে রাতেই কাজটা শেষ করতে হবে। দিনের বেলা কাজ করা খুবই অপছন্দ চাঁদের বুড়ির। তাই প্রথমে বসলো চরকা নিয়ে। সুতো কাটতে। পেঁজা তুলো চরকায় তুলে সুতো কাটছে বুড়ি। তুলোটা বেশ ভালো পড়েছে। সুতোও কাটছে খুব দ্রুত। মাঝ রাত গড়ানোর আগেই সুতো কাটা শেষ। এবার চাদর বোনার পালা। ধবধবে সাদা হবে চাদর।

ভোরের আলো ফোটার আগেই তৈরি হয়ে গেলে বিশাল সফেদ চাদর। একবার তুলে নাকে ধরে ঘ্রান নিলো বুড়ি। নতুন কাপড়ের ঘ্রানই আলাদা। এ চাদর বেলা পোহালেই গোটা চাঁদ জুড়ে বিছিয়ে দেওয়া হবে। তাতে ফুটবে চাঁদের আলো।

আবার কাব্য চলে এলো বুড়ির মনে ‘এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো। ’

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো চাঁদের বুড়ি। রাতভর টানা কাজের ক্লান্তি তাকে ঘুমের দেশে ভুলিয়ে রাখলো। ঘুম ঘখন ভাঙলো তখন আকাশে আঁধার। বুড়ির তো তখন মরণ দশা। হায় হায়! রাত নেমে গেছে, চাঁদে চাদর বসানো হয়নি। ভরা পূর্ণিমার রাতে এমন ঘটনা তো আগে ঘটেনি।

কুঁজো বুড়ি তড়িঘড়ি করে চাদর নিয়ে ছুটলো বিছাবে বলে। তখন আবার ছুটে যাচ্ছে বাতাস। এবার অনেক হন্তদন্ত দেখালো তাকে। ছুটতে ছুটতেই বললো- এই ভর বিকেলে চাদর বিছাচ্ছো বুড়ি, ব্যাপার কি?

এ কথায় অবাক বুড়ি বলে উঠলো- চারিদিকে আঁধার, আর তুমি বলছো ভর বিকেল!

বাতাস বললো, নয়তো কি? আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, তাই তুমি আঁধার দেখছো।

এবার সত্যি টনক নড়লো বুড়ির। সত্যিই তো আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। দলা দলা কালো মেঘে গোটা আকাশ ছাওয়া। ভেসে আসছে পিলে চমকানো মেঘের গর্জন।

দমকা ছড়িয়ে ছুটলো বাতাস। বুড়ির মনে তখন কালো মেঘের ছায়া। হায় রাত নাগাদ মেঘ না সরলে পূর্ণিমা হবে কি করে। এতো কষ্ট করে বানানো চাদর বুঝি আর কোনো কাজেই লাগছে না!

মন খারাপ করে আবার ডেরায় ঢুকে পড়লো বুড়ি। এবার মেঘ কেটে যাওয়ার আর সূর্য ডোবার অপেক্ষা। কিন্তু কই মেঘ তো কাটছে না। সূর্য ডোবার সময় হয়ে গেছে। দ্রুত বের হয়ে বুড়ি চাদরটি পুরো চাঁদের গায়ে বিছিয়ে দিলো।

সময় গড়াতে থাকে। ডেরায় বসে বসে বুড়ির মন আর মানে না। কী হচ্ছে আজ এসব। বাতাস এর মধ্যে বার কয়েক তার পাশ দিয়ে ছুটে ছুটে গেলো। কথা বলার তার যেন আর সময়ই নেই।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। এরপর ক্রমেই তা গভীর হতে থাকে। রাত যত গভীর হয় মেঘ যেন আকাশকে ততোই জাপটে ধরে। মেঘের গর্জন বাড়তে থাকে। বাড়ে দমকা হাওয়ার ঝাপটা।

এত কষ্টে বোনা চাদর কোনো কাজেই লাগলো না, মনের দুঃখে সে কথাই ভাবতে থাকে বুড়ি। এক পর্যায়ে ফুটে ওঠে দিনের আলো। তখন দুঃখ ভরা মনে বুড়ি চাদের ওপর বিছিয়ে রাখা চাদর তুলে আনতে যায়। এক কোনার দিকে চাদর তুলে বুড়ি দেখতে পায় পৃথিবীটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। গাছপালা উপড়ে গেছে। মরে পড়ে আছে হাজারো মানুষ, পশু, পাখি।

চাঁদের শরীরে ছড়ানো চাদর গুটাতে গুটাতে ভাবে প্রকৃতির এ কোন খেয়াল, সে বোঝে না। প্রায়ই দেখতে পায় বড় বড় দুর্যোগে কাতারে কাতারে মারা পড়ছে মানুষ।

তোমরা কি জানো সেই রাতটিতেই সিডর বয়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশে। তাতে প্রাণ হারিয়েছিলো হাজারো মানুষ।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।