ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ইচ্ছে পূরণের স্কুল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১১
ইচ্ছে পূরণের স্কুল

১০ বছরের ফুটফুটে একটি শিশু আঁখি। মায়া ভরা মুখটি তার সদা হাস্যজ্জ্বল।

হাতে গোলাপফুল ভর্তি বালতি। পথচারীদের কাছে তার একটিই আকুতি, ‘একটা ফুল ন্যান না’। কেউ তার আহ্বানে সাড়া দেয়, কেউবা ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

আঁখির মতো শতাধিক পথশিশু রয়েছে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দরিদ্রতার কারণে যাদের অধিকাংশই পথশিশুর খাতায় নাম লিখেছে। যে বয়সে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে মাথায় তুলে নিয়েছে জীবন সংগ্রামের বোঝা। বয়সে কম হলেও তাদের দায়িত্ব অনেক। কেননা তাদের উপার্জনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল তাদের পরিবার।

এদের কেউ ফুল, চকলেট, পানি বেচে আবার কেউবা দোকানে কাজ করে। এইসব সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের দিন কাটে রোদ বৃষ্টিতে ভিজে। আর রাত কাটে ফুটপাত অথবা গাছের নিচে। সোহরাওয়াদীঁ উদ্যানে মাদক আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠছে ওরা।

জীবনের অনেক মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত এসব শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে উদ্যোগী হয়েছে হিউম্যান সেফটি ফাউন্ডেশন (এইচএসএফ) নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। পথশিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে বৃক্ষমায়া শিশু বিকাশ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে ৩০ জন পথশিশু সপ্তাহে তিনদিন লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। সপ্তাহে একদিন রয়েছে শরীর চর্চা ও সাংস্কৃতিক ক্লাস। ক্লাস শেষে সব শিক্ষার্থীকে দুপুরের খাবার বাবদ ২০ টাকা করে দেওয়া হয়।
 
বৃক্ষমায়া শিশু বিকাশ কেন্দ্রের শিক্ষার্থী ও ফুল বিক্রেতা শারমিন বলে, ‘আগে আমি আমার নাম লিখতে পারতাম না, এখন আমি আমার নাম লিখতে পারি, হিসাব করতে পারি। তাই কেউ এ্যাহন আমারে ঠকাইতে পারে না। ’

একই সঙ্গে আরেক শিক্ষার্থী শাহীন বলে ওঠে, ‘আমার লেখাপড়া করার খুব শখ। কিন্তু গরিব বইলা স্কুলে যাইতে পারি না। বৃক্ষমায়া স্কুল আমার ইচ্ছাপূরণ করছে। এই স্কুলের আপারা আমাগো আদর কইরা ক্লাস নেয়। আমাগো পিকনিকে লইয়া যায়, চিড়িয়াখানায় বেড়াইতে লইয়া যায়, ঈদের সময় নতুন জামা কাপড় আর সেমাই দেয়। লেখাপড়া কইরা ডাক্তার হইতে চাই। ’

এই কেন্দ্রের শিক্ষার্থী সাবিনার মা রাবেয়া বলেন, ‘মাইয়া আর আমি ফুল বেইচা বাইচা আছি। দিন আনি দিন খাই। মাইয়ারে লেখাপড়া কারাবার পারি না। কিন্তু মাইয়াডার শখ লেখাপড়া করব। তাই মাইয়াডারে বৃক্ষমায়া স্কুলে পাঠাই। মাইয়া আমার লেখাপড়া শিখছে ভাইবা ভালাই লাগে। ’

ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের উদ্যোক্তা ও সংগঠনটির চেয়ারম্যান এম এ মুকিত বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা লেখাপড়া করছি, সর্বোচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছি। সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে থাকার পরও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। পথশিশুরা যাতে শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ পায় তার জন্য আমাদের এই প্রয়াস। আমরা শুধু ওদের পুঁথিগত শিক্ষাই প্রদান করি না, তাদেরকে আমরা নৈতিক শিক্ষাও দিয়ে থাকি। যাতে তারা ভবিষ্যতে দেশের সুনাগরিক হতে গড়ে ওঠতে পারে। ’

সংগঠনের ভাইস চেয়ারম্যান ফারজানা বিলকিস বলেন, ‘প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমাদের সংগঠন বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের মার্চ মাস থেকে আমাদের এই কার্যক্রম শুরু। প্রতি ঈদে আমরা পথশিশু এবং তাদের পরিবারকে ঈদের পোশাকসহ চিনি ও সেমাই দিয়ে থাকি। তাদের বিভিন্ন সমস্যায় আমরা সহযোগিতা করা চেষ্টা করি। কিছুদিন আগে আমারা সংগঠনের পক্ষ থেকে এক দুস্থ মহিলাকে সেলাই মেশিন দিয়েছি।

তানভীর, লোপা, সংগীতা, অমৃতা, জয়, আমিনুল সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এরা সবাই এই কেন্দ্রের নিয়মিত শিক্ষক।

তানভীর বলেন, ‘এখানে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে। অনেকে ভালো অভিনয়, নাচ, গান করতে পারে। কিন্তু সুযোগের অভাবে তারা তাদের মেধা প্রকাশ করতে পারছে না। আমরা তাদের এই সুযোগটা তৈরি করে দিতে চাই’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘নি:সন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। স্কুলটি পথশিশুদের লেখাপড়া ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে জেনে আমি খুবই আনন্দিত। ’

স্কুল ছুটি হবার আগে সব শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে গায় ‘আমরা করবো জয়’। এই বৃক্ষমায়া শিশু বিকাশ কেন্দ্রে আসার পর থেকে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন উদ্দীপনা। তারা আর শোষিত বঞ্চিত হতে চায় না। জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে চায়।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।