ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

একজন সুখী রাজপুত্তুরের গল্প (চতুর্থ পর্ব)

মূল: অস্কার ওয়াইল্ড <br>অনুবাদ: সামিও শীশ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১১
একজন সুখী রাজপুত্তুরের গল্প (চতুর্থ পর্ব)

‘রাজপুত্র ভাই, আমি এই কাজটা করতে পারব না’, ছলছল চোখ করে পাখিছানা কথাগুলো বলে।
‘পাখিছানা, শোন আমি যা বলছি তাই কর, রাজপুত্র বলল।



পাখিছানা রাজপুত্তুরের এক চোখ থেকে নীলাপাথরটি তুলে দেয় এবং ছেলেটার কাছে নিয়ে যায়। ছেলেটার ঘরের ছাদে বড় একটা গর্ত আছে। তার ফাঁক দিয়ে নীলাটা ছেলেটার ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। ছেলেটা কানমাথা মুড়িয়ে ছিল তাই সে পাখির ডানা ঝাপটার শব্দ শুনতে পায় না। সে শুধু দেখে তার ঘরের শুকনো ফুলগুলোর মাঝে একটা নীলা পড়ে আছে।

‘যাক শেষ পর্যন্ত আমার লেখা লোকে বুঝতে পারছে। নিশ্চয়ই আমার কোনো ভক্ত পাঠক আমাকে উপহার পাঠিয়েছে। ’ খুব পরিতৃপ্ত মন নিয়ে ছেলেটি মনে মনে কথাগুলো বলল।

পরের দিন পাখিছানা ঘাটে যায়। নাবিকেরা জাহাজের মাস্তুল তুলছে, দল বেঁধে বলছে, ‘হেঁইয়ো, হেঁইয়ো। ’ পাখিছানা একটু আবদারের সুরে বলে, ‘আমি তোমাদের সাথে মিশরে যাব। ’ নাবিকেরা কেউই আপত্তি করল না। আকাশে যখন চাঁদ উঠল, সেই স্নিগ্ধ আলোতে রাজপুত্তুরকে পাখিছানা বলে, ‘আমি বিদায় জানাতে এসেছি। ’

রাজপুত্তুর বলে, ‘পাখিছানা আর একটি রাত থেকে যাও না?’ পাখিছানা তখন বলে, ‘শীতকাল এসে গেছে। কদিন পর এখানে কনকনে ঠাণ্ডা পড়বে, তুষার পড়বে। মিশরে এখন গরম পড়ছে, কুমিররা নদীর ধারে কাদাতে আয়াস করে শুয়ে আছে শুয়ে শুয়ে সবুজ তাল গাছ দেখে। আমার বন্ধুরা বালবেক (বালবেককে বলা হয় সূর্যের শহর, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় সূর্য পূজার কেন্দ্র ছিল) মন্দিরে বাসা বানাচ্ছে। ওখানের গোলাপি আর সাদা কবুতরগুলোকে দেখছে আর কিচির মিচির করছে। প্রিয় রাজপুত্তুর, তোমাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে কিন্তু সত্যি বলছি তোমাকে কখনও ভুলব না। পরের বসন্তে যখন আসব তখন তোমার জন্য এই লাল রুবির চেয়েও বেশি গাঢ় লাল রুবি নিয়ে আসব, নীলা নিয়ে আসব সমুদ্রের পনির মতো নীল রঙের। তোমাকে দেব সবগুলো। ’
    
রাজপুত্তুর পাখিছানাকে বলে, ‘ঐ ময়দানটা দেখ। ওখারে দিয়াশিলাইয়ের বাক্স নিয়ে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিয়াশিলাইয়ের কাঠিগুলো নর্দমায় পড়ে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। সে ভয়ের চোটে কাঁদছে। সে দিয়াশিলাইগুলো বিক্রি করে বাসায় টাকা নিয়ে যেতে না পারলে তার বাবা তাকে অনেক মারবে। এই ঠাণ্ডার মধ্যেও মেয়েটার পায়ে কোনো জুতা নাই, মাথায় কোন টুপি নাই। তুমি আমার আরেক চোখ থেকে নীলাপাথরটা নাও আর মেয়েটাকে দিয়ে আস। তাহলে তাকে আর মার খেতে হবে না। ’

‘ঠিক আছে, আমি তোমার সাথে আরও একরাত থাকব কিন্তু তোমার চোখ থেকে পাথর তুলতে পারব না। এই পাথরটা তুললে তো তুমি পুরোপুরি কানা হয়ে যাবে। ’ পাখিছানা বলে।

‘পাখিছানা শোন, আমি যা বলছি তাই কর। ’ রাজপুত্তুর একটু হুকুমের সুরে বলে। পাখিছানা রাজপুত্তুরের আরেকটা চোখ থেকে নীলাটা তুলে নেয়।
 
পাখিছানা রাজপুত্তুরের আরেকটি চোখের পাথরটি নিয়ে উড়ে যায়। উড়ে গিয়ে মেয়েটির হাতের কাছে ফেলে দেয়। মেয়েটি তার হাতের মুঠোতে পাথরটি তুলে বলে,‘কী সুন্দর রঙিন কাঁচের টুকরা। ’ মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাড়ির দিকে যায়।

পাখিছানা রাজপুত্তুরের কাছে ফিরে আসে। রাজপুত্তুরকে বলে, ‘এখন তুমি পুরোপুরি কানা। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আমি তোমার সাথেই থাকব। ’

‘না না পাখিছানা, তুমি মিশরে চলে যাও। ’ রাজপুত্তুর বলে।
‘আমি তোমার সাথেই থাকব’ বলে পাখিছানা রাজপুত্তুরের পায়ের কাছে শুয়ে পড়ে।

পরদিন সারাটা সময় পাখিছানা রাজপুত্তুরের কাঁধে বসে থাকে। তাকে আজব আজব দেশের গল্পের শোনায়। সে তাকে নীল নদের তীরে সারি সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা লাল আইবিস পাখিরা কী করে গোল্ডফিস ধরে সে কথা বলে। বলে পৃথিবীর সমান বুড়ো সবজান্তা স্ফিংসের কথা। আরও শোনায় আরব বণিকদের কথা- তারা উট নিয়ে চলে আর পাথরের তসবিহ বিক্রি করে। আবার বলে, আবলুস কাঠের মতো কালো চাঁদের পাহাড়ের রাজার গল্প যে রাজা একটা বড় ক্রিস্টাল বলকে পূজা করে। আরও শোনায় তাল গাছে শুয়ে থাকা  সবুজ রঙের বিকট শাপের কথা, এই শাপকে বিশজন পূজারি মিষ্টি, মধু খাওয়ায়। বলে বড় বড় পাতার ভেলায় করে ভাসা পিগমিরা (বিষুবীয় আফ্রিকার খর্বাকৃতি জনগোষ্ঠী) সারাক্ষণ খালি প্রজাপতিদের সাথে যুদ্ধ করে।

সব শুনে রাজপুত্তুর বলে, ‘প্রিয় পাখিছানা তুমি দারুণ দারুণ গল্প বললে। কিন্তু জান, সবচেয়ে দারুণ গল্প হচ্ছে এই পৃথিবীর মানুষের দুঃখ কষ্টের গল্প। এর চেয়ে রহস্যময় গল্প আর নেই। তুমি উড়ে উড়ে শহরটাকে দেখ আর আমাকে বল তুমি কী দেখলে?’

রাজপুত্তুরের কথা মতো পাখিছানা শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। দেখে যে নয়নাভিরাম অট্টালিকা আর তার ছায়াতেই খোলা আকাশের নিচে আছে গৃহহীন নরনারী। শহরের অন্ধকার গলির ভিতরে শোনে ক্ষুধাতুর শিশুদের আর্তনাদ। ব্রিজের নিচে দেখে দুইটা ক্ষুধার্ত বাচ্চা গায়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে শরীরের শীত কমানো চেষ্টা করছে। হঠাৎ দারোগা ধমকিয়ে বলে, ‘এখান থেকে ভাগ। ’ শীত আর তার ওপর উপরি ঠাণ্ডা বৃষ্টির মধ্যে বাচ্চা দুইটা হাঁটা আরম্ভ করে।

পাখিছানা এসব দেখে। সে যা যা দেখল সব রাজপুত্তুরকে এসে বলে।
‘তুমি আমার শরীরের প্রতিটি জায়গা থেকে সমস্ত সোনা খুলে নাও, সোনাগুলো ওদেরকে দাও। দেখি ওরা খুশি হয় কিনা?’ রাজপুত্তুর পাখিছানাকে বলে।

চলবে...

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।