ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

রবীন্দ্র রচনাবলী

বুদ্ধদেব বসুর গল্প (তৃতীয় পর্ব)

সংগ্রহ ও ভূমিকা : সৈকত হাবিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১১
বুদ্ধদেব বসুর গল্প (তৃতীয় পর্ব)

পরের দিন রবিবার। দুপুরবেলা খাওয়ার পরে মামা-মামি বকুলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন সিনেমা দেখতে, ফল্গু ঘুরঘুর করতে-করতে সেই ড্রয়িংরুমে এসে বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়ালো।

পানু-ভানু কাছেই বসে ছিলো, তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ফল্গু হঠাৎ বলে ফেললো, ‘আচ্ছা, এর একখানা বই পড়বার জন্য নেয়া যায় না?’
পানু বললে, ‘অ্যাঁ?’ আগের রাতে তার বাবা যেমন করে ‘অ্যাঁ’ বলেছিলেন, ঠিক তেমনি করেই বললে।
‘এই যে এখানে রবীন্দ্র-রচনাবলী রয়েছে’, ফল্গু মুখ ফিরিয়ে তাদের দিকে তাকালো, ‘এর একখানা একটু নেয়া যায় না পড়ার জন্য?’
কথা শুনে দু-ভাই চকিতে একবার পরস্পরের দিকে তাকালো, তারপর ফিক করে হেসে ফেললো।
ফল্গু একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বললে, ‘তোমরা এ-সব বই পড়ো না?’
এবার হি-হি করে হেসে উঠলো দু-ভাই।
ফল্গু কিছুতেই ভাবতে পারলে না যে সে হাসবার মতো কিছু বলেছে। রীতিমতো অবাক হয়ে বললে, ‘হাসছো কেন?’
বড়ো ভাই পানু বললে, ‘তুমি বলছো কী, ফল্গু-দা? ও-সব বই তুমি পড়বে?’
‘কেন? এ এমন একটা অসম্ভব কথা কী’, ফল্গু আরো বেশি অবাক হলো।
ছোটো ভাই ভানু গম্ভীরভাবে বললে, ‘বাঃ, পড়লে ময়লা হয় যদি?’
‘যদি পাতা ছিঁড়ে যায়?’ বললে পানু।
‘যদি কালি লাগে মলাটে?’
‘যদি কোণ যায় দুমড়ে?’
‘বাবা একদিন,’ ভানু বলতে লাগলো, ‘কী-একটা কথার বানান দেখবার জন্য ঐ মোটা লাল ডিকশনারিটা বের করতে যাচ্ছিলেন, মা এমন তাড়া দিলেন যে বই তক্ষুনি ফিরে গেলো আলমারিতে। আমার জেম ডিকশনারিটা বাবা চেয়ে নিলেন অগত্যা- কিন্তু তাতে ও-কথাটা পাওয়া গেলো না- তারপর বাবা তার এক প্রোফেসর বন্ধুকে টেলিফোন করে জেনে নিলেন বানানটা। ’
ফল্গু মনে-মনে বললে, ‘ছেলে দুটো ভারি ফাজিল তো!’ মুখে বললে, ‘আলমারির চাবি কার কাছে?’ এমনভাবে বললে যেন ওদের কথা সে শোনেইনি।
পানু বললে, ‘চাবি হারিয়ে গেছে। ’
‘হারিয়ে গেছে মানে?’
‘হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই আছে। সেই যে- ভানু, মনে নেই- সেই যে একবার বীণাপিসি এসে আলমারির একখানা বই ধার চেয়েছিলেন- মা-বাবা একবার চোখোচোখি করলেন, তারপর মা বললেন, চাবি হারিয়ে গেছে। ’
ভানু বললে, ‘সেই যে একবার চাবি হারালো, তারপর আর খুঁজেই পাওয়া গেলো না। এ নিয়ে কতবার যে মাকে বলতে শুনলাম, ‘চাবি হারিয়ে গেছে!’
দু-ভাই আবার একসঙ্গে হেসে উঠলো।
ফল্গু মনে-মনে বিরক্ত হয়ে জিগেস করলে, ‘তোমাদের কখনো ইচ্ছেও করে না এ-সব বই পড়তে?’
‘না, আমাদের ও-সব ইচ্ছে-টিচ্ছে নেই,’ বলে পানু পাড়ার লাইব্রেরি থেকে ধার করে আনা একখানা তেল চিটচিটে ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়তে লেগে গেলো, আর ভানু মেঝেতে লুডো বিছিয়ে বললে, ‘একটু খেলবে, ফল্গু-দা?’
‘নাঃ’। আর-কিছু না-বলে ফল্গু চলে এলো সেখান থেকে। পানু-ভানু একেবারে বাজে- এত বই বাড়িতে, কোনোদিন একখানার পাতা উল্টিয়েও দেখেনি! আর কী সব যা তা বলছিলো!
সেদিন মামা আড়াই-শো টাকা দিয়ে একটা অ্যালসেশিয়ান বাচ্চা-কুকুর কিনে নিয়ে এলেন বাড়িতে। রাতে খাওয়ার পরে সবাই মিলে অনেকক্ষণ ধরে সেই কুকুরের বাচ্চা নিয়ে আলোচনা চললো। কোথায় তার কেনেল হবে, কী খাবে সে, কেমন করে ‘মানুষ’ করে তুলতে হবে তাকে, বড়ো হয়ে কেমন জলজ্যান্ত নেকড়ে বাঘের মতো দেখতে হবে, এ-সব কথায় মা, বাবা আর তিনটি ছেলেমেয়ে সকলেরই সমান উৎসাহ দেখা গেলো। তারপর রাত যখন এগারোটা বেজে গেলো, মামা একটা-দুটো হাই তুলে বললেন, ‘এবার শুয়ে পড়া যাক’, আর পানু-ভানু দুজনেই টাইগারকে নিজের বিছানার অংশ ছেড়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো, তখন কথাবার্তার মধ্যে কোনো একটা বিরতির সুযোগে ফল্গু মামার দিকে তাকিয়ে বেশ চেঁচিয়ে স্পষ্ট করে বললে, ‘আমাকে একখানা রবীন্দ্র-রচনাবলী পড়তে দেবে, মামা?’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।