ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

রবীন্দ্র রচনাবলী

বুদ্ধদেব বসুর গল্প (চতুর্থ পর্ব)

সংগ্রহ ও ভূমিকা : সৈকত হাবিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১১
বুদ্ধদেব বসুর গল্প (চতুর্থ পর্ব)

ঘরের মধ্যে হঠাৎ এমন স্তব্ধতা নামলো, যেন কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু-সংবাদ উচ্চারিত হয়েছে এইমাত্র। এমনকি, সাক্ষাৎ টাইগারকে সবাই যেন ভুলে গেলো তখনকার মতো।

মামা পাথরের মতো গম্ভীর মুখ করে বসে রইলেন, বকুলের হাসিখুশি মুখে ভীষণ দুশ্চিন্তার ছায়া নামলো, পানু-ভানুর মুখ হাঁ হয়ে গেলো, চোখ উঠলো কপালে। সেই নিথর স্তব্ধতাকে প্রকম্পিত করে ফল্গু আরো একটু চেঁচিয়ে আরো একবার বললে, ‘আমাকে একখানা রবীন্দ্র-রচনাবলী পড়তে দেবে, মামা?’
এতক্ষণে কথা বললেন মামি- অন্য সমস্তগুলি চোখ জোড়া-জোড়া হয়ে তার মুখের ওপর এসে পড়লো।
-‘রবীন্দ্র-রচনাবলী? পড়বে?’
‘এই একটু যদি-’ ফল্গু বিনীত সুরে জবাব দিলে।
‘সত্যি পড়বে?’
এবার একটু অবাক হলো ফল্গু, মনে-মনে একটু রেগেও গেলো। সত্যি পড়বে মানে? মামিমা কি ভাবেন রবীন্দ্রনাথের লেখা সে বুঝবে না?
‘এখনই পড়বে?’ পুনরায় প্রশু করলেন মামিমা।
‘যদি কোনো অসুবিধে না হয়-’
‘না, না- তবে কিনা- এই- রাত তো কম হলো না। ’
‘এমন আর বেশি রাত কী- আর ঘুমোবার আগে বিছানায় শুয়ে বই পড়তে আমার ভালোই লাগে। ’
মামিমা চুপ করে বসে থাকলেন একটু, তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখি- চাবিটা আবার-’
খুব আস্তে তিনি উঠলেন, খুব আস্তে হাঁটলেন। পানু, ভানু, বকুল অবাক হয়ে দেখলো, বইয়ের আলমারি খোলা হচ্ছে। ‘কোন খণ্ড নেবে?’ জিগেস করতে মামির প্রায় গলা ভাঙলো।
‘যেটা হয়। ’

মামি প্রায় মিনিটখানেক চিন্তা করলেন, তারপর বারোর খণ্ড বের করেই যেন শিউরে উঠলেন। ‘উঃ, বিশ্রী দেখাচ্ছে- ঠিক ফোকলা দাঁত!’ তক্ষুনি সেটা ফিরিয়ে রেখে হাত দিলেন প্রথম খণ্ডে। ‘এখানটায় ফাঁকাটা তেমন বোঝা যায় না-’
ফল্গু তাড়াতাড়ি বললো, ‘বেশ তো, প্রথম খণ্ডেই হবে আমার। ’

মামি যতক্ষণে বইখানা ফল্গুর হাতে তুলে দিলেন, ততক্ষণে পানু-ভানুর চোখ প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু ফল্গুর আর কোনোদিকেই মন নেই। বই নিয়ে এক ছুটে সে ঘরে। খুশিতে বিছানায় গড়ালো খানিকক্ষণ, শান্ত হয়ে শুয়ে আস্তে তুলে নিলো বইখানা, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলো কয়েকবার, অত্যন্ত মৃদু করে স্পর্শ করলো মসৃণ পাতাগুলি, গালে ছোঁওয়ালো, মুখের কাছে এনে নতুন বইয়ের গন্ধ নিলো বুক ভরে। অবশেষে কোনো-একটা পাতা খুলে যেই সে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, তখনই দরজার বাইরে শোনা গেলো মামির গলা, ‘ফল্গু!’

ফল্গু ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো। ‘কী, মামিমা, কী হয়েছে?’
‘কিচ্ছু হয়নি। আমি ভাবলাম তুমি বুঝি বই বুকে নিয়েই ঘুমুলে। ওতে বড্ড পাতা দুমড়ে যায়- আর ভীষণ বোবায় ধরে ঘুমের মধ্যে। ’

‘তোমার কিচ্ছু ভাবনা নেই, মামিমা, পড়তে-পড়তে ঘুমুবো না আমি। ’
‘আর কতক্ষণ পড়বে’?

‘এই- যতক্ষণ না ঘুম পায়। ’
‘বেশি রাত জেগো না, ফল্গু- স্বাস্থ্যের কথাও তো ভাবা চাই। ’ বলে মামিমা শুকনো হেসে বিদায় নিলেন।
ফল্গু আবার শুয়ে পড়ে ‘সন্ধ্যা-সংগীত’ খুললো। মিনিট দশেকও বোধহয় কাটেনি, আবার বাইরে মামির গলা :
‘ফল্গু!’
‘মামিমা!’
‘না- জিগেস করছিলাম, তোমার ঘরে খাবার জল-টল দিয়েছে? আর-কিছু চাই?’
মামিমার সৌজন্যে মুগ্ধ হয়ে ফল্গু বললে, ‘সব ঠিক আছে, মামিমা- কিচ্ছু চাই না। তুমি শুয়ে পড়ো। ’
‘তুমি আর কত রাত জাগবে?’
‘ঘুম পেলেই ঘুমিয়ে পড়বো, মামিমা। ’
‘আচ্ছা...’
এর পর ফল্গু যখন দু-একবার পাতা উল্টিয়েছে, এবং সবেমাত্র যখন তার মন লেগেছে বইয়ের পাতায়, ঠিক তক্ষুনি :
‘ফল্গু!’
হঠাৎ ফল্গুর মনে হলো যে মামিমা তাকে কিছু একটা বলতে চান যা বলতে তাঁর সংকোচ হচ্ছে। এবার সে বিছানা ছেড়ে নামলো, বই হাতেই দরজায় গেলো।
মামিমা তাকে দেখে খুব যেন আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘ও, ঘুমোওনি!’
‘ঘুমোবো কেন? আমি তো-’
‘ও কী!’ মামি হঠাৎ যেন সাপ দেখে চমকে উঠলেন, ‘বইয়ের ভেতর আঙুল!’
‘বইয়ের ভেতর আঙুল?’ ফল্গু প্রথমে বুঝলো না কথাটা, তারপর হঠাৎ বললে, ‘এই- ওখানটায় পড়ছিলাম কিনা, তাই-’ বলতে বলতে আঙুল তুলে আনলো।

‘ওতে বই নষ্ট হয় বড়ো, আঙুলের দাগও লাগে পাতায়- ও-রকম করা কি ভালো? যাক, হলো তো তোমার পড়া? আমি দ্যাখো বাপু তেমন লোক নই যে বাড়ির ছেলে একখানা বই পড়তে চাইলে বই দেবো না। কিন্তু পড়া হয়ে গেলে বই তুলে রেখে, আলমারিতে চাবি দিয়ে তবে তো আমি শোবো। সেইজন্য বার-বার ডাকছিলাম তোমাকে- কিছু মনে করলে না তো?...’
‘না, মামিমা’, একটু চুপ করে থেকে ফল্গু বললে, ‘আমি কিচ্ছু মনে করিনি। এই নাও বই, তুলে রাখো, চাবি দাও আলমারিতে, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে শোও। ’

বইখানা হাতে নিয়ে মামিমা বললেন, ‘আবার যদি কখনো কোনো বই পড়তে ইচ্ছে হয়, বোলো কিন্তু আমাকে- লজ্জা  কোরো না। ’

*                                *                                   *

ফল্গু পরের দিনই কোনো একটা অছিলা করে মাদারীপুর চলে গেলো, তারপর ক্লাশ আরম্ভ হবার সময় যখন ফিরে এলো, সোজা উঠলো হোস্টেলে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।