তিনি যখন বৃদ্ধ হলেন তখন জনগণের খুব দুঃশ্চিন্তা হলো। রাজতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী তার একমাত্র পুত্র ভুবন রায় হবেন হেমপুরের পরবর্তী রাজা।
রাজা ভুবন রায় দিনে দিনে একজন ভয়ংকর অত্যাচারী শাসকে পরিণত হলেন। সাধারণ জনগণকে শাস্তি দিয়েই লাভ করতেন রাজা আত্মতৃপ্তি। মনে যা চাইত তা-ই করতেন। রাজার অত্যাচার থেকে ডাক্তার, হেকিম থেকে শুরু করে কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার, জেলে-নাপিত, কাঠুরিয়া, মুচি-মেথর কেউই রেহাই পেত না। শাসনকার্যে কোনো মন্ত্রীর অবহেলা দেখলেও রাজা তাকে ছাড়তেন না। এছাড়াও রানির কাজে সহযোগিতা করার জন্য রাজার লোকজনরা গ্রাম-শহর থেকে যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষদের ধরে আনতো। রানির হুকুমে তারা দাস-দাসীর মতো দিনরাত পরিশ্রম করতো। রাজা যুবক ছেলেমেয়েদের জোর ধরে যুদ্ধে পাঠাতেন। যুদ্ধ করতে কেউ রাজী না হলে বা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কেউ পলায়ন করলে রাজা তাদের মৃত্যুদণ্ড অথবা জেলখানায় বন্দি করে রাখতেন।
হেমপুরের চাষিরাও রাজা ভুবন রায়কে ভয় পেত। রাজার লোকজনদের ইচ্ছা অনুযায়ী চাষিরা চাষাবাদ না করলে বা সময়মতো খাজনা দিতে না পারলে রাজা তাদের কঠোরভাবে শাস্তি দিতেন। কখনও কখনও জমি-জমা কেড়ে নিতেন। কাঠুরিয়াও খুব বিপদে ছিল। গাছ কাটার অপরাধে তাদের শাস্তি দেওয়া হতো। অথচ এটাই ছিল তাদের পেশা। একসময় তাদের না খেয়ে মরার উপক্রম হয়। বাঁচার তাগিদে তারা অন্য পেশা বেছে নেয়। রাজা অক্ষম ভিক্ষুকদের পছন্দ করতেন না। তাদেরও বিভিন্ন কাজ করাতে বাধ্য করতেন।
রাজা একবার সিদ্ধান্ত নিলেন যে তার প্রাসাদটা একটু সম্প্রসারণ করাবেন। এজন্য রাজার লোকজনরা অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের প্রাসাদে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। রাজ্যের প্রখ্যাত প্রকৌশলীরা রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রাসাদ নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা করেন। কয়েকজন প্রকৌশলী রাজার সঙ্গে দেখা করার সাহস পাননি। অথচ ওই প্রকৌশলীরা রাজার আদেশ অমান্য করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে মন্তব্য করে গুপ্তচররা রাজার কান ভারী করে। ফলে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের জেলখানায় বন্দি করে রাখে।
অন্য একদিন গুপ্তচররা রাজার কানে দেয় যে হেমপুরের জেলেরা ঠিকমতো মাছ ধরে না। তাই বাজারে মাছের দাম হুহু করে বাড়ছে। এতে সাধারণ ক্রেতাদের কষ্ট হচ্ছে। এর জন্য জেলেরাই দায়ী। রাজা গোপনে হাট-বাজার পরিদর্শন করে এর সত্যতার প্রমাণ পান। এতে তিনি জেলেদের প্রতি ভীষণ রেগে যান। সব জেলেদের ধরে এনে জবাব চান। জেলেরা রাজাকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে এখন গ্রীষ্মকাল। জলাশয়ে পানি কম রয়েছে। তাই ঠিকমতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। রাজা মনে করেন এসব জেলেদের খোঁড়া যুক্তি। রাজা তাদের এই বলে সতর্ক করে দেয় যে আগামীকাল থেকে বাজারে মাছের সরবরাহ কম হলে তোমাদের কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। এভাবে রাজা লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। রাজার বিচারে কেউ সন্তুষ্ট না হলেও প্রাণের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পেতো না সাহস।
গুপ্তচররা একবার রাজাকে বোঝালো, যে রাজ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এভাবে শিক্ষিত লোকজনের সংখ্যা বাড়লে একদিন তারা আপনার কথা শুনবে না। আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। তখন আপনার জন্য রাজ্য শাসন করা কঠিন হয়ে পড়বে। একসময় আপনি রাজ্য হারাবেন। লোকজন যত অশিক্ষিত থাকবে ততই আপনার জন্য মঙ্গল হবে। গুপ্তচরদের কথা বিশ্বাস করে রাজা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি সারা রাজ্যে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেন- হেমপুর রাজ্যে এখন থেকে কেউ পড়ালেখা করতে পারবে না। আজ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হলো। এভাবে রাজার অত্যাচার দিন দিন বাড়তেই থাকে। সবাই ভয়ে ভয়ে জীবনযাপন করতে থাকে। আর মনে মনে রাজার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে।
রাজপুত্র একবার দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। আরোগ্য লাভের জন্য রাজ্যের অভিজ্ঞ হেকিম, কবিরাজ ও চিকিৎসকদের ডাকা হলো। সবাই জান পরান দিয়ে রাজপুত্রকে সারিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করলো। কিন্তু কেউই সফল হতে পারলো না। অবশেষে মুন্সী মুরাদ নামে এক প্রখ্যাত চিকিৎসককে আনা হলো। চিকিৎসা শুরু করার একদিন পরেই রাজপুত্রের মৃত্যু হলো। রাজা ভাবলেন মুন্সী মুরাদের ভুল চিকিৎসার কারণে তার পুত্রের মৃত্যু হয়েছে। এমন অভিযোগে মুন্সী মুরাদ রাজাকে বোঝাতে ব্যর্থ হলো যে তার ভুল চিকিৎসায় রাজপুত্রের মৃত্যু হয়নি। তার শারীরিক অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল। হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতিতেই তার মৃত্যু হয়। এসব কথায় রাজা কর্ণপাত করেননি। ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা মুন্সী মুরাদকে বন্দি করেন। তারপর রাজা নিজেই তার বিচারকাজ শুরু করেন। বিচারের রায়ে চিকিৎসককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য দিন তারিখে ধার্য করা হলো। রাজার প্রহসন বিচারে অনেক মন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়।
তার মধ্যে সাধন ফকির নামে এক মন্ত্রী ছিল। তিনি রাজাকে এই বলে অবহিত করেন যে, উনি হেমপুর রাজ্যের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। ওনার চিকিৎসার গুণে অসংখ্য মানুষ আরোগ্য লাভ করে। আপনি একবার দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। রাজ্যের সব চিকিৎসক সেই রোগের চিকিৎসা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই মুন্সী মুরাদই বছর দশেক আগে আপনার সেই দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করে আপনার প্রাণ বাঁচান। আপনি এর জন্য তাকে পুরস্কারও দিয়েছিলেন। একই রোগে আপনি যদি আবার আক্রান্ত হন তাহলে আমরা বড় বিপদে পড়ে যাবো।
একথা শুনে ভুবন রায় দু’চোখ বড় বড় করে হুংকার দিয়ে বলেন, তুমি কী বলতে চাচ্ছ? আমি বলছিলাম মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তাকে অন্য কোনো শাস্তি দেওয়া যায় কিনা একটু ভেবে দেখবেন। জবাবে রাজা চিৎকার করে বলেন, মৃত্যুদণ্ডই তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি। কোনোভাবেই এ শাস্তি কমানো সম্ভব নয়। তবে তার যদি কোনো শেষ ইচ্ছা থাকে তাহলে আমি তা পূরণ করবো। তুমি ওনার কাছে জেনে নাও তার কোনো শেষ ইচ্ছা আছে কিনা? মনে রাখবে হাতে মাত্র একদিন সময় রয়েছে। পরশু তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।
মন্ত্রী সাধন ফকির ছিল খুব চালাক ও জ্ঞানী। রাজার প্রতিশ্রুতির কথা শুনে সে মনে মনে খুব খুশি হয়। রাজাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সে এটাকেই উত্তম সুযোগ বলে মনে করে। মুরাদ মুন্সীর সঙ্গে দেখা করার জন্য মন্ত্রী জেলখানায় ছুটে যায়। হেমপুর রাজ্যের জনগণকে বাঁচানোর জন্য সে তার কাছে অনুনয় বিনয় করে। জনগণকে কীভাবে বাঁচান সম্ভব তার সকল কৌশল মন্ত্রী তাকে শিখিয়ে দেয়। মুরাদ মুন্সী অবেশেষে মন্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। পরিকল্পনা মোতাবেক মন্ত্রী রাজার কাছে ফিরে গিয়ে মুরাদ মুন্সীর অভিপ্রায়ের কথা তাকে অবহিত করে।
মন্ত্রী বলেন, তার ইচ্ছা মৃত্যুর আগে একদিনের জন্য হেমপুর রাজ্যের রাজা হবেন। ইচ্ছার কথা শুনে রাজা ভুবন রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। একপর্যায়ে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। কিন্তু মানমর্যাদার কথা স্মরণ করে রাজা তার প্রতিশ্রুতির কথা ভঙ্গ করতে সাহস পেলেন না। তাই শেষপর্যন্ত রাজা তার ইচ্ছা পূরণ করতে সম্মত হন। তিনি মন্ত্রীদের সামনে ঘোষণা দেন, আগামীকাল মুরাদ মুন্সীই হবেন হেমপুর রাজ্যের রাজা। আমি আগামীকাল সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকে রাজ্যের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবো। তোমরা এর জন্য যা যা করার তাই করবে।
পরেরদিন রাজা ভুবন রায় যথাসময়ে প্রখ্যাত চিকিৎসক মুরাদ মুন্সীর হাতে একদিনের জন্য হেমপুর রাজ্যের শাসনভার তুলে দিলেন। শাসনভার তুলে দিয়ে সদ্য বিদায়ী রাজা ভুবন রায় হলেন সাধারণ মানুষ। আর হেমপুর রাজ্যের নতুন রাজা হলেন মুরাদ মুন্সী। কাল বিলম্ব না করে নতুন রাজা সব মন্ত্রী, উজির, সেনাপ্রধান ও রাজ কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠক করেন। হেমপুরের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তার বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। এই কাজে নতুন রাজা সবার সাহায্য প্রার্থনা করেন। সবাই রাজার আহ্বানে সাড়া দেন। তারা রাজাকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
নতুন রাজা বলেন, আমরা সবাই জানি সাবেক রাজা ভুবন রায় ছিলেন খুব অত্যাচারী। তিনি অসংখ্য মানুষকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। তার অত্যাচারে হেমপুরের সবাই অতিষ্ঠ। আমার প্রথম কাজ হবে সাবেক রাজার বিচার করা। এরপর তার গুপ্তচরদের বিচার করা। নতুন রাজা সাবেক রাজা ভুবন রায়কে বন্দি করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন। ভুবন রায় বুঝতে পারলেন তিনি ফেঁসে গেছেন। এখন কৃতকর্মের জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। বাঁচার জন্য কোনো পথ খুঁজে পেলেন না। উজির বিচার কাজ শুরু করেন। বিচারে ভুবন রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো এবং তা সূর্যাস্তের আগেই কার্যকর করার আদেশ দেন।
উজিরের রায় অমান্য করার সাহস কারোরই ছিল না। তাই সত্যি সত্যিই সূর্যাস্তের পূর্বেই ভুবন রায়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো।
সাবেক রাজা ভুবন রায়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় হেমপুর রাজ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। পরেরদিন সবার সম্মতিতে মুরাদ মুন্সীই হলো হেমপুর রাজ্যের পরবর্তী রাজা। মুরাদ মুন্সী গুপ্তচরদের বিচার করে রাজ্যের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এরপর একে একে বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করতে থাকেন। মনের আনন্দে সবাই দেশ গড়ার কাজে লিপ্ত হন। অবশেষে নতুন রাজার শাসনে সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯
এএ