ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

চার মামলায় দণ্ডিত তারেক, জোবাইদার প্রথম রায়

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২১ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২৩
চার মামলায় দণ্ডিত তারেক, জোবাইদার প্রথম রায়

ঢাকা: দুর্নীতির অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। তবে সরকারের নির্বাহী আদেশে তিনি এখন নিজ বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান তার ছেলে তারেক রহমান। লন্ডনে থাকা তারেকও ইতোমধ্যে চারটি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হয়েছেন।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের একাধিক মামলায় সাজা হলেও তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার রায় হচ্ছে বুধবার (২ আগস্ট)। এদিন ঢাকার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. আছাদুজ্জামানের আদালতে তারেক রহমান ও জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলায় রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে।

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় চিকিৎসার কথা বলে দেশ ছাড়েন তারেক রহমান। তবে দীর্ঘ ১৬ বছরে তিনি আর দেশে ফেরেননি। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলায় রায় হয়। যেখানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

মানি লন্ডারিং মামলা
২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা পাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং আইনে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারেক রহমান ও গিয়াস উদ্দিন মামুনের বিরুদ্ধে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করে দুদক। ২০১০ সালের ৬ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। সেই মামলায় ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে অভিযোগ গঠন করা হয়।

২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর তারেক রহমানকে খালাস দেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোতাহার হোসেন। তবে তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ৭ বছর কারাদণ্ড ও ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ। পাশাপাশি তাকে ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দণ্ডিত হন তারেক রহমান। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় খালেদা জিয়াসহ আসামিদের বিরুদ্ধে এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে এই মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়।

এ মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানসহ পাঁচজনকে ১০ বছর কারাদণ্ডের রায় দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫’র বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। খালেদা জিয়াকে দেওয়া হয় ৫ বছরের দণ্ড। এছাড়া প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন। আর তারেক রহমানসহ অন্যদের সাজা বহাল রাখেন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা
চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। সেই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর সেই দুটি মামলায় তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-১’র তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় আরও ১১ আসামির।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির মামলা
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নানা মন্তব্য করেন তারেক রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে নড়াইলে দায়ের করা মানহানি মামলায় ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন জেলার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২’র বিচারক আমাতুল মোর্শেদা। একইসঙ্গে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

স্ত্রীসহ প্রথম রায় তারেক রহমানের
তারেক রহমান এর আগে চারটি মামলায় দণ্ডিত হলেও এবার দুদকের করা অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগের এই মামলায় তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকেও আসামি করা হয়। মামলাটিতে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় তারেকের বিরুদ্ধে এবং একই অভিযোগে সহযোগী হিসেবে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের সর্বোচ্চ ১৩ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

মামলার অভিযোগ বিষয়ে দুদক কৌশলী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এই মামলার এজাহারে ৪ কোটি ৮১ লাখ টাকার জ্ঞাত বহির্ভূত আয় ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আনা হয়। তবে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী থেকে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আমরা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭ (১) তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৫৮ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং উক্ত অপরাধে সহায়তার জন্য জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করি। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ৪২ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছি। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আমরা এই অপরাধটা প্রমাণ করতে পেরেছি এবং আইন অনুযায়ী তাদের সর্বোচ্চ ১৩ বছরের শাস্তি দাবি করেছি।

তবে বিএনপি এই মামলাটিকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে অভিহিত করছে। মঙ্গলবার (১ আগস্ট) বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই মামলায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সাক্ষী নিয়ে বুধবার রায় প্রচারের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। দেশে লাখ লাখ মামলার জট থাকলেও তাদের এই মামলায় ১৬ দিনে ৪২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। রাত ৮টা—৯টা পর্যন্ত একতরফাভাবে সাক্ষী নেওয়া হয়েছে। আমাদের আইনজীবীরা এ ধরনের বিচার কাজের বৈধতা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে গেলে তাদের উপর পুলিশ ও সরকার দলীয় আইনজীবীরা একাধিকবার হামলা চালিয়েছে। তাদেরকে আদালত কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিচারের নামে ক্যামেরা ট্রায়াল চালানো হয়েছে। আমরা আশংকা করছি, সরকারী নীল নকশায় পরিচালিত এই তথাকথিত বিচার প্রক্রিয়ায় তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে সাজা প্রদান করা হতে পারে।

চলতি বছর ১৩ এপ্রিল এই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন একই আদালত। এরপর গত ২১ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়৷ ওইদিন আদালতে জবানবন্দি দেন মামলার বাদী দুদকের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ জহুরুল হুদা। গত ২৪ জুলাই এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওইদিন সর্বশেষ সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। মামলাটিতে মোট ৫৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার মালিক হওয়া এবং সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় এ মামলা করে দুদক। মামলায় তারেক রহমান, জোবাইদা রহমান ও তার মা অর্থাৎ তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানুকে আসামি করা হয়।

২০০৮ সালে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপরই মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন জোবাইদা। ওই বছরই এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।

গত বছর এই মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে রুল খারিজ করেন হাইকোর্ট। সেই রায়ের বিরুদ্ধে তার পক্ষে লিভ টু আপিল করা হলে গত বছর ১৩ এপ্রিল তা খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর উচ্চ আদালতের রায়ের কপি বিচারিক আদালতে পৌঁছলে চলতি বছর মামলার বিচারকাজ শুরু হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২৩
কেআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।