সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপিল শুনানির শেষ দিন বৃহস্পতিবার (০১ জুন) এমন মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রেখেছেন।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।
সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটের পর গত বছরের ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ০৮ মে শুরু হয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১ কার্যদিবস এ আপিলের শুনানি হয়। এর মধ্যে চার দিন শুনানির করেন অ্যামিকাস কিউরিরা। ১০ জনের মধ্যে ৯ অ্যামিকাস কিউরিই সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
বৃহস্পতিবারের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘৯৬(৩) এ বলা নেই যে, বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদ তদন্ত করবে’।
‘ষোড়শ সংশোধনীর ফলে প্রতিস্থাপিত অনুচ্ছেদ ৯৬(৩) এর পরিপ্রেক্ষিতে যে আইন প্রণীত হবে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই আইনের বিধান বিবেচনা করে বোঝা যাবে যে, অপসারণের বিধান তদন্তের বিষয়ে কোন ব্যক্তিদের সংযুক্ত করা হবে, তদন্ত নিরপেক্ষ হবে কি-না বা সে আইনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে কি-না। এ আইন না করা পর্যন্ত ৯৬(২) এবং ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের পরিপন্থী কি-না- তা বিচার করার অবকাশ নেই’।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘মন্ত্রীরা যদি কোনো অসদাচরণের কারণে অভিযুক্ত হন, তাহলে রাজনৈতিক কারণেই তিনি তার পদ হারান। সংসদের মেয়াদকাল শেষ হলে বা সংসদ ভেঙে গেলে ফের তাদের জনগণের সামনে যেতে হয়। জনগণই তাদের বিগত বছরগুলোর কর্মকাণ্ডের বিচার-বিবেচনা করেন এবং জনতার আদালতেই তাদের বিচার হয়ে যায়। কিন্তু বিচার বিভাগের জবাবদিহিতার জায়গা নেই’।
মাহবুবে আলম বলেন, ‘বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ। নিজেদের বিচার নিজেরা করাটা ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। এ বিচার করতে বিচারপতিদের আবেগ অনুভূতির ঊর্ধ্বে ওঠা সম্ভব নাও হতে পারে। যেমন চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে। বিএমডিসি কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার জন্য বা শর্ত ভঙ্গের কারণে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, তার নজির নেই। তাই আইন করার আগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা ঠিক হবে না’।
এ সময় আদালত বলেন, ‘সব বিভাগতো নিজেদের বিচার নিজেরাই করে’। প্রধান বিচারপতি এ বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেন, ‘বিষয়টি যদি সংসদের হাতে দেওয়া হয়, তখন বিচারকরা ১০টার পরিবর্তে সাড়ে ১০টায় বসলেন। এটি কে দেখবেন? সংসদ সদস্যরা কি এখানে এসে দেখবেন?’
‘কোনো বিচারপতিই প্রধান বিচারপতির অধীন নন। তারা স্বাধীন। প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে ক্ষমতা যদি নিয়ে যান, তাহলে জাজদের কে তদারকি করবেন। কেউ প্রধান বিচারপতিকে মানবে না। শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে’।
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা কেন এত শঙ্কাবোধ করছেন?’
আদালত বলেন, ‘আপনি (অ্যাটর্নি জেনারেল) বলেছেন, যেকোনো নাগরিক সংসদে গিয়ে একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন। এটি হলে তো সব শেষ করে দেবেন’।
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘শেষ হবে কেন? সামরিক আইন দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান করা হয়েছে। তা যদি রাখা হয়, তবে সেটি হবে ইতিহাসের বিরাট ভুল। আপনারা কেন সংসদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?’
তখন আদালত বলেন, ‘সামরিক শাসনের সময়ের আইন যদি বাদ দেন, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন। তাহলে তো চতুর্থ সংশোধনীতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তাই নয় কি?’
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘চতুর্থ সংশোধনী কেন, আমরা তো আদি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদেই যাবো’।
আদালত বলেন, ‘আপনার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। জানার জন্য, বোঝার জন্য শুনছি, প্রশ্ন করছি। তবে রাষ্ট্র যতো ধরনের অপকর্ম করেছে, তা থেকে আমরাই বিচার বিভাগ উদ্ধার করেছি। এ বিষয়ে এখনও রায় দিচ্ছি’।
শুনানির শেষ পর্যায়ে রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টকে কিছু অভিমত নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো রিভিউ আবেদন করেননি’।
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যখন কোনো রায়ে সিদ্ধান্ত দেন, সে সিদ্ধান্ত বিলুপ্ত করে সংসদ কোনো আইন করতে পারে না’।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৫ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৭
ইএস/এএসআর