‘ভুয়া খবর ও ঘৃণামূলক বক্তব্য, কারণ ও পরিণাম; কিভাবে তা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধংস করছে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন আইনমন্ত্রী।
শনিবার (০৬ এপ্রিল) রাজধানীর কসমস সেন্টারে ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, সিঙ্গাপুর এর প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদষ্টো ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রথম বক্তা ছিলেন অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যান্ড ইন্টারনেট ডেমোক্রেসি-এর প্রেসিডেন্ট এবং ইউরোপ ও আইটি আইন বিশেষজ্ঞ ড্যান শেফেট।
আইনমন্ত্রী বলেন, ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর বাংলাদেশের নতুন কোনো শব্দ বা ধারণা নয়। ‘খবর’ ও ‘ভুয়া খবর’ অনেকটা সত্য ও মিথ্যার মতোই সমান্তরালভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী অনেক ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিলো। তারা আমাদের মহান স্বাধীনতাকে নিয়ে ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিলো, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে নিয়ে ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিলো, বঙ্গবন্ধুর অবদানকে নিয়ে ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিলো। এমনকি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যও তারা দেশ ও বিদেশে অনেক ফেইক নিউজ ছড়িয়েছে এবং তা বিভিন্ন প্রকৃতিতে ছড়িয়েছে।
বিগত প্রায় দুই দশকে আমাদের গণমাধ্যমের প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফেইক নিউজের প্রকৃতিও পরিবর্তন হয়েছে মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী বলেন, আবার গণমাধ্যমের প্রকৃতি পরিবর্তন হওয়ায় ফেইক নিউজ প্রচারের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। এখন শুধু ট্র্যাডিশনাল সংবাদমাধ্যমে নয় বরং অনলাইন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক টুইটার বা ইউটিউবের মাধ্যমে ভুয়া খবর, ইমেজ, ভিডিও বা হেট স্পিচ ছড়িয়ে পড়ছে এবং এসবের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির কণ্ঠস্বর নকল করে ভুয়া খবর তৈরি করে প্রচার করা হচ্ছে। আবার সুপ্রতিষ্ঠিত নামিদামি সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইট নকল করে তার মাধ্যমে ফেইক নিউজ ইমেজ, হেট স্পিচ ছড়ানো হচ্ছে। ফলে সাধারণ পাঠক এই সকল ফেইক নিউজ থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে কেউ কেউ এমন সব সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন যার শিরোনামে কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদ প্রতিষ্ঠান লোগো যুক্ত করা থাকে। এতে পাঠক সেই সংবাদ ওই প্রতিষ্ঠানের মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আর এ ধরনের বিভ্রান্তির ফলেই অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
আনিসুল হক বলেন, আমাদের দেশে প্রধানত পাঁচটি উদ্দেশ্যে ফেইক নিউজ চর্চা করা হয়। এক. সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ানো। দুই. উগ্র রাজনৈতিক ধর্মীয় মিথ্যাচার প্রচার। তিন. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। চার. জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। ৫. অবৈজ্ঞানিক জল্পনা-কল্পনা প্রচার করা। এক্ষেত্রে শেষের ফেইক নিউজে কারও বড় রকমের ক্ষতি না হলেও অন্যান্য ধরনের ফেইক নিউজে সহিংস প্রভাব পড়ে জনজীবনে।
তিনি বলেন, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি সাংবাদিকতা-বহির্ভূত যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের বড় বিপদের দিকটা হলো এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য অতি দ্রুত গতিতে সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদজনক হচ্ছে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো, যাদের অধিকাংশই তথ্যের সত্য-মিথ্যা খতিয়ে দেখে না। তাদের দ্বারা যেকোনো চাঞ্চল্যকর ভুয়া খবর মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো সংবাদমাধ্যমে।
আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশসহ অনেক দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যম এখন সংবাদের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ফেসবুক-টুইটার ব্যবহার করে। কাজটা দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের সাথে করলে ঝুঁকির আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু অধিকাংশ অনলাইন সংবাদমাধ্যম তা করে না। ফলে ভুয়া খবর পুনঃপুন ব্যবহার ঘটতেই থাকে।
এসব ফেইক নিউজের প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন ,সাইবার আদালত গঠন এবং গুজব প্রতিরোধ ও অবহতিকরণ সেল গঠনের পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং অনলাইন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া ফেইক নিউজের প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে বিটিআরসি, আইসিটি বিভাগ, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে বলে জানান আনিসুল হক।
আইনমন্ত্রীর মতে, সরকারের একার পক্ষে এ কাজ সফলভাবে করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তৈরি করে তা দ্রুততম সময়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে যাতে তারা সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারস্থ না হয়। সংবাদমাধ্যমগুলোকে সত্য এড়ানোর প্রবণতা/নীরবতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের সত্য জানার পথ যেখানে বন্ধ হয়ে যায়, ফেইক নিউজের পথচলা সেখান থেকে শুরু হয়। যে সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট হুবহু নকল হবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তাদেরকেই নিতে হবে। সাইট নকলের ক্ষেত্রে যে কোনো হাউজের আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া ফেইক নিউজ চিহ্নিতকরণের জন্য নতুন টেকনলজি ডেভেলপ করা উচিত। কারণ প্রযুক্তি কে প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবেলা করা উচিত।
আনিসুল হক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ফেইক নিউজ তৈরি করে প্রচার করছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। তাদের অৎর্থের উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া কোনটা নিউজ আর কোনটা ফেইক নিউজ এ সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা রাখতে হবে। আমরা আসলে কী ধরনের লিংক বা সংবাদ ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছি তা শেয়ারের আগে অন্তত কয়েকবার চিন্তা করে দেখতে হবে। কারণ অসচেতনভাবে হলেও আপনার আমার শেয়ার করা একটি ফেইক নিউজের কারণে যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। যার দায় আপনি আমি এড়াতে পারবো না। আজ আপনি সজ্ঞানে ফেইক নিউজ শেয়ার করলে, আগামীকাল যে নিজেই এর শিকার হবেন না, তা বলা যায় না। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু দেখেই গুজব ছড়ানো যাবে না। বরং ধৈর্য ধরে তথ্যটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৯
ইএস/এমজেএফ