আর শুনানির সময় বিএসটিআই আবারো শাহনীলা ফেরদৌসীর প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আদালত বলেছেন, তারা (এনএফএসএল) বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার চুক্তির আওতায় কাজ করে।
আদালত আরও বলেন, ২০১৭ সালে আইসিডিআরবি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির পরীক্ষায়ও এসব বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু আপনারা বলছেন, কিছু পান না। আপনাদের পরীক্ষায় সত্য উদঘাটিত হচ্ছে না কেন? আপনাদের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এরপর আদালত দুধ, দই এবং পশু খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে তাতে কি পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, অ্যান্টিবায়োটিক, রাসায়নিক, সীসাসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে তা নিরূপণ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ২৩ জুনের মধ্যে এ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২১ মে) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম। বিএসটিআই’র পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান মামুন, দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিনউদ্দিন মানিক। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের (এনএফএসএল) প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার শাহিন আহমেদ।
এর আগে হাইকোর্ট গত ১৫ মে এক আদেশে ডা. শাহনীলা ফেরদৌসীকে তার প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতে হাজির হয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন অধ্যাপক ড. শাহনীলা ফেরদৌসী।
এ সময় তিনি বলেন, নেদারল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে কাজ করি। এরপর সেই প্রতিবেদন যাচাই করে ফাও (আন্তর্জাতিক ফুড ও অ্যাগ্রিকালচার অরগানাইজেশন) তা প্রকাশ করে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাদের এমওইউ চুক্তির আওতায়ই এ কাজ করা হয়। একারণে আন্তর্জাতিকমান বজায় রেখেই নমুনা সংগ্রহ ও তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। আর এনএসএফএল আইএসও সনদপ্রাপ্ত।
তিনি বলেন, আমাদের ল্যাবের প্রতিবেদন পেলেই তারা তা প্রকাশ করে না। এই পরীক্ষা ও প্রতিবেদন ঠিক আছে কিনা তা বিভিন্ন দেশের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।
এ প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর বিএসটিআই’র আইনজীবী বলেন, তাদের প্রতিবেদন যে সত্য তা প্রমাণ করার সুযোগ কি? তারাতো অন্য কোনো ল্যাবে যাচাই করেনি। তারা নমুনা সংগ্রহ করেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার থেকে। কিন্তু পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও যশোরেই সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদিত হয়। সেখান থেকে তারা কোনো নমুনা সংগহ না করে ঢালাওভাবে বলে দিলো দুধে এইসব রয়েছে।
এসময় শাহনীলা ফেরদৌসী বলেন, এখানে শুধুই তিনটি জেলা নয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পণ্য রয়েছে। সুতরাং বিএসটিআই’র দাবি যথাযথ নয়।
তিনি বলেন, খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসার উপস্থিতি নিয়ে আইসিডিডিআরবি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন ২০১৭ সালেও প্রকাশিত হয়েছে। তা ইন্টারনেটেই রয়েছে। তাই শুধু একমাত্র আমাদের প্রতিবেদনেই যে ওইসব ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে তা নয়। আইসিডিডিআরবি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিএসটিআই কি করেছে তা জানা নেই।
এ সময় আদালত বিএসটিআই’র আইনজীবীকে বলেন, আপনাদের দায়িত্ব আপনারা পালন করছেন না। এসি রুমে বসে আছেন। আপনারা কেন আগে পরীক্ষা করে পদক্ষেপ নিতে পারলেন না।
এসময় বিএসটিআই’র আইনজীবী বলেন, আমরা ৫২টি পণ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আগে করেননি। আদালতের নির্দেশের পর এটা করা হয়েছে।
শুনানিতে বিএসটিআই’র আইনজীবী যৌথভাবে নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য আদালতের আদেশ দেওয়ার জন্য আবেদন জানান। জবাবে আদালত বলেন, আগে আপনাদের রিপোর্ট পাই। এরপর সেটা দেখা যাবে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে বলেন, বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। তাদের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে দুদকের কার্যক্রম।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘গাভির দুধ ও দইয়ে অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক, সিসা!’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাভির দুধে (প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া) সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপাদান পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে বিভিন্ন অণুজীবও। একই সঙ্গে প্যাকেটজাত গাভীর দুধেও অ্যান্টিবায়োটিক ও সীসা পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত। বাদ পড়েনি দইও। দুগ্ধজাত এ পণ্যেও মিলেছে সীসা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) গবেষণায় এসব ফলাফল উঠে এসেছে। সংস্থাটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গাভীর খাবার, দুধ, দই ও প্যাকেটজাত দুধ নিয়ে এ জরিপের কাজ করেছে।
ওই প্রতিবেদন নজরে আসার পর ১১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট স্বতপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন।
আদেশে গাভীর দুধ (প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া) ও বাজারের প্যাকেটজাত দুধ, দই এবং গো খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে তাতে কি পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসা, রাসায়নিক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর তা নিরূপণে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
কমিটিকে প্রতি ৬ মাস পরপর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য মানুষ যাতে সঠিক তথ্য সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুধ, দই ও গো-খাদ্যে ভেজাল মেশানোর ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে দুধ, দই এবং গো-খাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে একটি কমিটি গঠন করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কমিটিকে তিনমাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
ওই আদেশের পর ৮ মে (বুধবার) নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম আদালতে ১৬ সদস্যের কমিটি গঠনের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
পরে ফরিদুল ইসলাম বলেছিলেন, ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কর্মপরিধিও তৈরি করেছেন। এর মধ্যে দুধ, দই ও পশুখাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করার বিষয়টি যোগ করতে বলেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০১১ ঘণ্টা, মে ২১,২০১৯
ইএস/জেডএস