ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

শিশু আইন-আদালত নিয়ে বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৯
শিশু আইন-আদালত নিয়ে বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে

ঢাকা: ‘শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগে এক ধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।’ এক শিশু আসামির জামিন নিয়ে করা আবেদনের রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দেন।

পুরান ঢাকার মো. ওসমান হত্যা মামলার আসামি শিশু মো. হৃদয়ের জামিন আবেদনের এক মামলায় হাইকোর্টের ১ আগস্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বুধবার (২১ আগস্ট) প্রকাশিত হয়।

আসামি হৃদয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এম মশিউর রহমান।


রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মৌদুদা বেগম, হাসিনা মমতাজ ও শাহানা পারভীন। আদালত হৃদয়কে জামিন দেন।

রায়ে আদালত বলেন, শিশু আইন ২০১৩-এ ধারা ২(১৬ক), ১৫ক এবং ১৬(৩) সংযোজিত হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের সংশয়, বিভ্রান্তি ও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিতের লক্ষ্যে সৃষ্ট সংশয়, বিভ্রান্তি ও অসঙ্গতি দূর করা অতি জরুরি। এখানে উল্লেখ করা আরও প্রাসঙ্গিক হবে যে, শিশু আইনের অধীনে কোন আদেশ প্রদানকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নাম, সিল ও পদবি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিচার পূর্বকালীন সময়ে বিভিন্ন আদেশ প্রদানকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল -এর নাম, সিল ব্যবহার করা হচ্ছে।

‘দৈনন্দিন বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে একথা উচ্চারণে আমাদের দ্বিধা নেই যে, শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগে এক ধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। ’

রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের অভিমত এই যে, এ ধরনের বিভিন্নমুখী প্রবণতার মূল কারণ শিশু আইনের ধারা ১৫ক এবং ১৬(৩)-এর সংযোজন। কারণ ওই দু’টি ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে গ্রহণের পর শিশু আদালতে মামলার নথি (কাগজাদি) পাঠানো না হওয়া পর্যন্ত শিশু আদালত কোনো অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারবে না।

আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি যে, ট্রাইব্যুনালগুলোর মধ্যে এ সংশয় হয়তো কাজ করে যে, অপরাধ আমলে নেওয়ার আগে শিশু আদালত হিসেবে এখতিয়ার প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। এ ধারণা একেবারে অবান্তর ও ভিত্তিহীন। কারণ আমরা যদি শিশু আইনের ধারা ২১, ২৯ ও ৫২-এর বিধানগুলো লক্ষ্য করি তা হলে এটা সুস্পষ্ট হবে যে, বিদ্যমান আইনেই শিশু আদালতকে বিচার পূর্ববর্তী অবস্থায় অর্থাৎ অপরাধ আমলে নেওয়ার আগে শিশুর বয়স, জামিন ও হেফাজত সংক্রান্ত বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। একজন শিশুকে গ্রেফতার পরবর্তী ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টা সময়ের মধ্যে নিকটস্থ শিশু আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে। উপরোক্ত আলোচনা এবং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আদালতের সুচিন্তিত, পর্যবেক্ষণ ও অভিমত এই যে, শিশু আইনে সাংঘর্ষিক অবস্থা, বিদ্যমান অসংগতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি  অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন; এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে যে, এ লক্ষ্যে সরকার দ্রুততার সঙ্গে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। সরকার শিশু আইন সংশোধন অথবা শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ৯৭-এর বিধান মূলে গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা অস্পষ্টতা ও অসংগতি দূর করতে পারে।

সরকার আইনের যথাযথ সংশোধন বা স্পষ্টীকরণ সম্পর্কে প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট ও শিশু আদালতগুলোকে নিম্ন লিখিত কার্যপদ্ধতি/প্রণালী অনুসরণে নির্দেশনা দেন আদালত।

এক. সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্টেট কেবল মামলার তদন্ত কার্যক্রম তদারকি করবেন এবং এ সংক্রান্তে নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় আদেশ এবং নির্দেশনা দেবেন;

দুই. রিমান্ড সংক্রান্ত আদেশ শিশু আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (ভিকটিম ও সাক্ষী) বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন;

তিন. তদন্ত চলাকালীন সময়ে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুকে মামলার ধার্য তারিখে ম্যাজিস্টেট আদালতে হাজিরা হতে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে;

চার. তদন্ত চলাকালে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর রিমান্ড, জামিন, বয়স নির্ধারণসহ অন্তবর্তী যে কোনো বিষয় শিশু আদালত নিষ্পত্তি করবে এবং এ সংক্রান্ত যে কোনো দরখাস্ত ম্যাজিস্টেট আদালতে দাখিল হলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্টেট নথিসহ ওই দরখাস্ত সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে পাঠাবেন; এবং সংশ্লিষ্ট শিশু আদালত ওই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করবে;

পাঁচ. অপরাধ আমলে নেওয়ার আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের অধীনে কোনো আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘শিশু আদালত’ হিসেবে আদেশ দেবে এবং এক্ষেত্রে বিচারক শিশু আদালতের বিচারক হিসেবে কার্য পরিচালনা এবং শিশু আদালতের নাম ও সিল ব্যবহার করবেন;

ছয়. আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো এই যে, আইন মন্দ (bad law) বা কঠোর (harsh law) হলেও তা অনুসরণ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশোধন বা বাতিল না হয়। সে কারণে নালিশি মামলার ক্ষেত্রে শিশু বিশেষ আইনগুলোর অধীনে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিশেষ আদালত বা ক্ষেত্রমত, ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের বিধান ও অত্র রায়ের পর্যবেক্ষণের আলোকে অভিযোগ (complaint) গ্রহণের পর প্রয়োজনীয় আইনি কার্যক্রম ও পরে অপরাধ আমলে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য কাগজাদি (নথি) সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠাবে; অতঃপর ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে নেওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ ও অপরাধ আমলে নিলে পরবর্তীতে কাগজাদি বিচারের জন্য শিশু আদালতে পাঠাবেন;

সাত. শিশু আইনের প্রাধান্যতার কারণে বিশেষ আইনের অধীনে জি. আর মামলার ক্ষেত্রে শিশু সংঘটিত অপরাধের জন্য আলাদা পুলিশ রিপোর্ট দেওয়ার বিধান থাকায় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অপরাধ আমলে নেবেন।

এই রায় ও আদেশের কপি প্রয়োজনীয় অবগতি ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালত/ট্রাইব্যুনালসহ সমাজকল্যাণ সচিব, আইন সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫১ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৯
ইএস/এএ   

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।