রাজশাহী: রাজশাহীর নওহাটা কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রত্যয় কুমার সাহা সামান্য পরিমাণ মাদকসহ পুলিশের হাতে আটক হন। তিনি ছয় মাস কারাগারে থেকে জামিনে মুক্তি পান।
আপসযোগ্য একটি মামলায় রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ৭০ বছর বয়সি বৃদ্ধ আমির উদ্দিনের এক বছরের সাজা হয়। সারাজীবনে তিনি এ প্রথম সাজা পেয়েছেন। সাজা হলেও বাইরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কারণ অপরাধ ও বয়স বিবেচনায় আদালত তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন।
আমির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য আদালত আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। বাড়িতে থেকে আমি স্বাক্ষর করা শিখেছি। আদালতের চেষ্টায় বয়স্ক ভাতাও পাচ্ছি। এজন্য আমি বিচার ব্যবস্থা ও সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।
রাজশাহী আদালত থেকে এমন সাজাপ্রাপ্ত অন্তত ২৩ আসামিকে কারাগারে যেতে হচ্ছে না। ছোটখাটো অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে সংশোধনের মাধ্যমে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ‘প্রবেশন’ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাড়িতে থাকার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ অনুযায়ী এমন সুবিধা পাচ্ছেন তারা।
বিচারকরা আসামি সম্পর্কে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তার প্রাক-প্রতিবেদন পেয়ে এমন রায় দিয়েছেন। এতে আদালতের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত আসামিরা সংশ্লিষ্ট সমাজকল্যাণ অফিসের একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে থাকবেন।
জানা গেছে, অধ্যাদেশটি অনেক পুরোনো হলেও বাংলাদেশে প্রয়োগ ছিল না বললেই চলে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এক নির্দেশনায় অধস্তন আদালতের বিচারকদের অধ্যাদেশটি অনুসরণের নির্দেশ দেন। এর পর থেকে এর দৃশ্যমান প্রয়োগ শুরু হয়।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবেশনের ফলে নিজেকে সংশোধন ও অপরাধ প্রবণতা থেকে নিবৃত্ত করতে আসামিরা উৎসাহী হবে। বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোতে দ্বিগুণের বেশি বন্দি, যাদের বেশিরভাগই মাদক মামলার আসামি। লঘুদণ্ডে অনেকেই কারাগারে গিয়ে দাগি আসামির সংস্পর্শে ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। প্রবেশনের ফলে এ প্রবণতা রোধ করা যাবে। এ ধরনের রায় বিচারাঙ্গনের মামলাজট নিরসনেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
রাজশাহী কোর্টের আইনজীবী শামীম আহমেদ বলেন, প্রথম ও লঘু অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন খুব ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। এর মাধ্যমে আসামিরা নিজেদের সংশোধনের চমৎকার সুযোগ পাচ্ছেন। আদালতের নির্ধারিত সময়ে তারা প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে থাকেন। এর ফলে একদিকে মামলার জট কমবে এবং আমাদের কারাগারগুলোতে আসামিদের চাপও কমবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, দেশের আদালতগুলোতে প্রবেশনের চর্চা ব্যাপক হারে হওয়া উচিত। পাশাপাশি এ আইনের কিছু সংশোধনীরও দরকার আছে। প্রবেশন বিষয়টির সঙ্গে প্রবেশন কর্মকর্তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আরও প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া দরকার। এছাড়া তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে।
রাজশাহীর প্রবেশন কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, আসামি সম্পর্কে আদালতে আমরা একটি প্রাক-প্রতিবেদন পাঠাই। প্রতিবেদনে এটি তার প্রথম অপরাধ কিনা, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা, প্রতিবেশীরা তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়। আদালতে প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত দেন।
আইনে যা বলা আছে
'প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০' এর ৪ ধারা অনুযায়ী, আগে দণ্ড পাননি কিংবা দুই বছরের বেশি মেয়াদে দণ্ড হবে না এমন অপরাধ ও আসামির ক্ষেত্রে প্রবেশন প্রযোজ্য হবে। তবে এক্ষেত্রে আসামির বয়স, চরিত্র, তার পূর্ব সামাজিক ও পারিবারিক ইতিহাস, দৈহিক কিংবা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরণ বা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বিচারক শর্তসাপেক্ষে এটি প্রয়োগ করবেন।
প্রবেশন অনুযায়ী, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাগারে আবদ্ধ কক্ষে নয়, মুক্ত বাতাসে পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্য পাবেন। শর্ত হিসেবে নতুন করে অপরাধ প্রবণতায় না জড়ানো ও সদাচরণ করতে হবে। এসব শর্ত ভঙ্গ হলে তার বিরুদ্ধে দেওয়া ওই দণ্ড কার্যকর হবে এবং সাজাভোগ করতে হবে।
অধ্যাদেশ ও সুপ্রিম কোর্টের পরিপত্র অনুযায়ী, এ ধরনের প্রবেশন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেটকে আদালতে প্রবেশন কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে তার অধীনে আসামিকে ন্যস্ত করবেন। আসামি ওই কর্মকর্তার অধীনে দণ্ডের মেয়াদ পর্যন্ত তদারকিতে থাকবেন।
তবে অধ্যাদেশের ৫ ধারা অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হওয়ার মতো কিংবা গুরুতর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন প্রযোজ্য হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
এসএস/আরবি/