ঢাকা: ‘আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে আইনের শাসন বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এটি বাস্তবে রূপ কখনই লাভ করবে না।
রাজধানীর কয়েকটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে সরকারের করা রিট মামলায় জারি করা রুলের রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েশ আল হারুনী। অন্যপক্ষে ছিলেন আইনজীবী সিহাব উদ্দিন মাহমুদ।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর এ রায় ঘোষণা করা হয়। যেটি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
রায়ের তথ্য মতে, ১৯৮৮ সালে কেএএম আশরাফ উদ্দিন কাকরাইলের ৫৬/৫৭ হোল্ডিংয়ের ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৬), লুৎফুন্নেছা রহমান চার কাঠা (বাড়ি নং-৫৬/১) এবং ১৯৮৯ সালে একেএম ইদ্রিস হোসেন তালুকদার ও তার স্ত্রী জামিলা খাতুন সাড়ে ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৭) জামির মালিকানা দাবি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে সেগুলো বাতিল চেয়ে সেগুনবাগিচার সেটেলমেন্ট আদালতে আবেদন করেন। আবেদনকারীরা সবাই দাবি করেন, তারা ১৯৭৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তারারাম জয়সুরিয়া ওরফে চিও রতন ওরফে তারারাম মুচির কাছ থেকে এই জমি কিনেছেন।
পরে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ১৬ কাঠা জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত রায় দেন।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পৃথক রিট আবেদনে জারি করা রুল মঞ্জুর করে রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়, ‘মূসা খালেদ এর নেতৃত্বে তৎকালীন প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত, ঢাকা নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং জালিয়াত চক্র বিনা দালিলিক এবং সাক্ষ্য ব্যতিরেকে হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় এবং জনগণের সম্পত্তি জালিয়াত চক্রের হাতে তুলে দেন। এই কাজের মাধ্যমে তৎকালীন প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত বিচার বিভাগের মর্যাদাহানি করেন। ’
রায়ে বলা হয়েছে, ‘হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রের সম্পত্তি, হাজার কোটি টাকার জনগণের সম্পত্তি, হাজার হাজার কোটি টাকার দেশের সম্পত্তি প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত ন্যূনতম দালিলিক এবং মৌখিক সাক্ষ্য প্রমাণ ব্যতিরেকে জালিয়াত, ঠক, বাটপার এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ’
রায়ে আরও বলা হয়, ‘মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ জায়গা হলো বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন, তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। তারা হতাশ হন, ক্ষুব্ধ হন, ক্রুদ্ধ হন, বিক্ষুব্ধ হন এবং বিকল্প খুঁজতে থাকেন। তখনই জনগণ মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মাফিয়া নেতাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাদের বিচার সেখানে চান। ’
‘আমরা বিচার বিভাগ যদি ব্যর্থ হই জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে তাহলে জনগণ বিকল্প উপায় খুঁজতে বাধ্য হবে, যেটি কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং এখন সময় এসেছে আমাদের বিচার বিভাগকে তথা জনগণের শেষ আশ্রয়স্থলকে আমূল সংস্কার করে, দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে সত্যের নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার। ’
রায়ে আরও বলা হয়, আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে আইনের শাসন শুধু বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি বাস্তবে রূপ কখনই লাভ করবে না।
‘রায়ে সম্পত্তি প্রতিবন্ধী কল্যাণের জন্য দখল এবং ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হলো। রায় প্রাপ্তির তিন মাসের মধ্যে ঢাকার জেলা প্রশাসক অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে নালিশি সম্পত্তিটি উদ্ধার করে নিউরো ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টে হস্তান্তর করে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে হলফনামা দেবেন। ’
রায়ের অনুলিপি সব বিচারকের কাছে ই-মেইলে পাঠানোর জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া রায়ের অনুলিপি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণের জন্যও পাঠানো হোক বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০২০
ইএস/টিএ