ঢাকা: এক বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ঘটে যায় মর্মান্তিক এক হত্যাকাণ্ড। সহপাঠী শিক্ষার্থীদের হাতে জীবন দিতে হয়েছিল বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বিকে।
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ঘটে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিনগত রাতে। সেই ঘটনার বছর ঘোরার আগেই এই হত্যাকাণ্ডে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর চার্জশিটভুক্ত ২৫ আসামির বিরুদ্ধেই অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়। সোমবার (০৫ অক্টোবর) আবরারের বাবা ও এই ঘটনায় হওয়া মামলার বাদী বরকতউল্লাহর জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
জবানবন্দিতে আবরার ফাহাদের বাবা বলেছেন, আসামিরা আমার ছেলে আবরার ফাহাদ রাব্বিকে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে অমানবিকভাবে শারীরিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ন্যায়বিচার চাই।
আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার বিচার হচ্ছে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে। আগামী ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত এই মামলার ধারাবাহিক সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য আছে। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রসিকিউশন প্যানেল গঠন করা হয়েছে। তারা হলেন-চিফ পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল, স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী ও আবু আব্দুল্লাহ ভূঁঞা।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আশা করছেন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা শেষ করার যে আইনগত সময়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার মধ্যেই বিচারটি শেষ হবে এবং দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।
জানতে চাইলে এই মামলায় নিযুক্ত স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পিপি এহসানুল হক সমাজী বাংলানিউজকে বলেন, আবরারের বাবার জবানবন্দির মধ্য দিয়ে এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আদালত এই মামলায় আগামী ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিক সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন রেখেছেন। আদালতের নির্ধারিত সময়েই আমরা রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের উপস্থাপন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আশা করছি দ্রুত বিচার আইনের বিধান অনুযায়ী যে সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার মধ্যেই এই মামলার বিচার শেষ হবে। তবে এক্ষেত্রে আসামিপক্ষেরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে প্রত্যাশা করে আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে আমরা সচেষ্ট আছি। সেক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপনে যাতে কোনো দুর্বলতা না থাকে আমরা সেই চেষ্টা করব। আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার শেষ হবে এবং দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হবে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু উশৃঙ্খল নেতাকর্মীর হাতে নির্দয় পিটুনির শিকার হয়ে মারা যান বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ। ঘটনার পরদিন নিহতের বাবা বরকতউল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি মামলা করেন।
গত বছর ১৩ নভেম্বর মামলায় ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ জোনাল টিমের পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
মামলার তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে ২১ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিওন, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, শাখা ছাত্রলীগ সদস্য মুনতাসির আল জেমি, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির ও ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মনিরুজ্জামান মনির, আকাশ হোসেন, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মাজেদুর রহমান, শামীম বিল্লাহ, মোয়াজ আবু হুরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত এবং এস এম মাহমুদ সেতু। পরে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ।
গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মিজানুর রহমান মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত ও এস এম মাহমুদ সেতু ছাড়া বাকি সবাই এজাহারভুক্ত আসামি।
মামলার আট আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা হলেন- ইফতি মোশাররফ সকাল, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, অনিক সরকার, মুজাহিদুর রহমান, মেহেদি হাসান রবিন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মনিরুজ্জামান মনির ও এএসএম নাজমুস সাদাত।
পরে গত বছর ১৮ নভেম্বর অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক চার আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কায়সারুল ইসলাম। পরোয়ানা অনুযায়ী পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করতে না পারায় গত বছর ৩ ডিসেম্বর তাদের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর চলতি বছর ৫ জানুয়ারি পলাতক আসামিদের হাজিরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের একদিন আগে মোর্শেদ অমত্য ইসলাম নামে পলাতক এক আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তাই এখন পলাতক থাকলেন আর তিন আসামি। তারা হলেন- মোর্শেদুজ্জামান জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোস্তবা রাফিদ। এর মধ্যে মোস্তবা রাফিদের নাম এজাহারে ছিল না।
চলতি বছর ১২ জানুয়ারি ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. কায়সারুল ইসলাম মামলার বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলির আদেশ দেন। সরকারি গেজেটের পর গত ১৮ মার্চ ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ স্থানান্তরের আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল ৬ এপ্রিল মামলায় অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য করলেও করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অভিযোগ গঠন শুনানি পিছিয়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০২০
কেআই/এইচএডি/