ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লন্ডন

রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র: মাদক সাম্রাজ্যের বাতিঘর সেলমিনহা

সৈয়দ আনাস পাশা, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৬
রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র: মাদক সাম্রাজ্যের বাতিঘর সেলমিনহা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রিও ডি জেনিরো (ব্রাজিল) থেকে: ব্যাপক নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকা বস্তিও যে পর্যটকদের আকর্ষণের স্থান হতে পারে তা বুঝা গোলা ব্রাজিলের অপরুপ নগরী রিও ডি জেনিরোতে এসে। অবশ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণেই সব পর্যটকের ভাগ্যে এই বস্তি পরিদর্শনের সুযোগ ঘটে না।



অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী নিয়ে কেউ কেউ হয়তো এই বস্তি পরিদর্শন করতে পারেন, আবার অনেককেই শুধু এর গল্প শুনেই তৃপ্ত থাকতে হয়। ব্রাজিলের এই বস্তি বিশ্বের মূলধারার মিডিয়াগুলোরও অন্যতম আকর্ষণীয় নিউজ আইটেম। বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা শুধু এইসব বস্তি নিয়ে স্টোরি করার জন্যই ব্রাজিল সফর করে থাকেন।

বস্তির পর্তুগিজ শব্দ হলো ফাভেলা। ব্রাজিলের বস্তি বা ফাভেলা বিশ্বখ্যাত। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের স্থান হলো রিও ডি জেনিরোর ফাভেলা।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যাদের কোথাও থাকার যায়গা ছিলো না, তারাই প্রথম এই বস্তি স্থাপন করে। এই বস্তির প্রথম বাসিন্দারা ছিলো মূলত আফ্রিকান এলাকাগুলো থেকে আসা। একসময় কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরাই এ এলাকায় বসবাস করতে করতো। কালের পরিক্রমায় এই বস্তি এখন অনেকটা আধুনিক।

রিও ডি জেনিরোর  বস্তি কিন্তু আমাদের দেশের বস্তির মতো নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার যেমন বাসা-বাড়িতে থাকে ঠিক তেমনই রিও’র বস্তি বা ফাভেলার ঘরবাড়ি। তবে এই বস্তি এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

রিও’র ফাভেলা নিয়ন্ত্রণ করে ড্রাগ ডিলাররা। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর ড্রাগ মার্কেটের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রিও ডি জেনিরোর এইসব ফাভেলা নিয়ন্ত্রক ড্রাগ ডিলারদের। এখানে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক বা সরকারের কোন সংস্থার প্রবেশাধিকার নেই। বস্তিবাসী ছাড়া আর কারো এখানে প্রবেশাধিকারে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। ড্রাগ ডিলারদের আইনই এখানে সবকিছু।

বস্তির বাসিন্দা যারা ছোটখাটো ব্যবসা করে, তাদের ট্যাক্স দিতে হয় ড্রাগ ডিলারদের। সাধারণ বাসিন্দাদের চলতে হয় ড্রাগ ডিলার বা মাদক ব্যবসায়ীদের কথামতো। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে এখানে পাহারা দেয় মাদক ব্যবসায়ীদের নিজস্ব সশস্ত্র কর্মী। পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধ নিত্যদিনের ঘটনা এখানে। এ যেন রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র।

রিও ডি জেনিরো’র বাঙ্গো এলাকায় এমন একটি ফাভেলা বা বস্তি সফরের সুযোগ হয়েছিলো বাংলানিউজের এই করেসপন্ডেন্ট এর। ফাভেলায় এনজিও পরিচালিত ‘সিমেনটে ডু আমানহা’ বা ‘আগামীর বীজ’ নামে একটি স্কুলের আমন্ত্রণে ২৩ ডিসেম্বর বাংলানিউজ প্রতিবেদক ওই ফাভেলা পরিদর্শন করেন। ওই বস্তিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এনজিও প্রতিষ্ঠাতা সেলমিনহা’র আমন্ত্রণে ফাভেলা পরিদর্শনে গেলে ‘লাইটহাউস অব ফাভেলা’ বা ‘বস্তির বাতিঘর’ খ্যাত নারী সেলমিনহা ঘুরে ঘুরে ফাভেলা ও তার পরিচালিত স্কুলটি দেখান বাংলানিউজ করেসপন্ডেন্টকে।

ওই ফাভেলা’র ড্রাগ ডিলারসহ ছোট বড় সবার কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র সেলমিনহা। তার স্কুলে ড্রাগ ডিলারদের সন্তানদেরও তিনি শিক্ষাদান করেন, তাই তারাও অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে সেলমিনহাকে। ফাভেলায় তার এই অবস্থানের কারণেই তিনি চাইলে যে কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাভেলা পরিদর্শনে নিয়ে যেতে পারেন। ২৩ ডিসেম্বর নিজের অফিসের গাড়ি পাঠিয়ে শেরাটন বাহা থেকে বাংলানিউজ করেসপন্ডেন্টকে ফাভেলায় নিয়ে যান সেলমিনহা। তিনি যখন হেঁটে হেঁটে ফাভেলা দেখাচ্ছিলেন, তখনও দামি দামি গাড়ি চড়ে ড্রাগ ডিলারদের চলা ফেরা দেখা যায় ফাভেলার রাস্তায়। তারা নিজেদের এলাকায় নতুন আগন্তক এই করেসপন্ডেন্ট ও তার সঙ্গীদের আড়চোখে দেখলেও সঙ্গে সেলমিনহাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এসময় রাস্তায়ও দেখা যায় খোলা অস্ত্র হাতে মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা কর্মীরা সতর্ক আছে।  

বাংলানিউজকে সেলমিনহা জানান, প্রায় প্রতিদিন বস্তি এলাকায় বন্দুক যুদ্ধ চলে। গতকালও বন্দুক যুদ্ধ হয়েছে। সেজন্য আজ ফাভেলা এত নীরব।

এরপরই তিনি দেখালেন, প্রতিটি ঘরের ওয়ালে ওয়ালে বুলেটের ছিদ্র। তিনি বলেন, ‘আমাকে ড্রাগডিলাররা শ্রদ্ধা করে, কারণ আমি তাদের সন্তানদেরও পড়াই। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন মাদক বাহিনী ও পুলিশের বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে কখন ক্রস ফায়ারে পড়ে আমার কোমলমতি স্কুলছাত্ররা মারা পড়ে, এই টেনশনেই আমি থাকি’।

তিনি বলেন, আজ আটাশ বছর ধরে আমি এই ‘স্বপ্নের চাষ’ করছি। ড্রাগ ভায়োলেন্সের মধ্যে জন্ম ও বেড়ে ওঠা শিশুরা একদিন এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্যান্যদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে, লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে এটিই আমার স্বপ্ন, এই স্বপ্নের চাষই আমি করছি।

সেলমিনহা জানান, তিনি নিজে এই বস্তিতে জন্মেছেন, বাবাহীন শিশু হিসেবে মায়ের হাত ধরে বেড়ে উঠেছেন।

তিনি বলেন, শিক্ষা ও খাদ্যহীন অবস্থায় ভায়োলেন্স শিশুদের জন্যে যে কত ভয়ঙ্কর তা আমি বুঝি। আর তাই রিও ডি জেনিরোর পশ্চিম জোনের এলায়েন্স টাউন বস্তিতে ১৯৮৭ সালে আমি এই স্কুল শুরু করি।

এই এলাকাটি ব্রাজিল সরকারের পরিত্যক্ত একটি অংশ জানিয়ে সেলমিনহা বলেন, সরকারের কোন দৃষ্টিই নেই রিও’র বস্তি এলাকাগুলোর প্রতি।

তিনি জানান, আমার জন্যে রেখে যাওয়া মায়ের একখণ্ড জমিতে স্কুলটি স্থানান্তরিত করে উন্নত পরিবেশে বাচ্চাদের শিক্ষাদান চালিয়ে যাচ্ছি।

সেলমিনহা বলেন, মানুষের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ২৮ বছর ধরে আমি এই স্বপ্নের চাষ করছি। এই স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব হতে শুরু করেছে। আমার এই স্কুল থেকে ইতোমধ্যে লেখাপড়া শেষে অনেকেই বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার ও আর্কিটেক্টসহ বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে কাজ করছেন।

‘বস্তির বাতিঘর’ খ্যাত সেলমিনহা জানান, মানুষের সাহায্য নিয়েই তিনি তার এনজিও’র কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই তাঁর স্কুল পরিদর্শন করছেন, কেউ কেউ সহাযোগিতাও করছেন।

নিজের টেবিলে ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের একটি ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা আমাদের এই স্কুল কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশের হাইকমিশনার স্কুলটি পরিদর্শন করে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

রাষ্ট্রদূত মিজারুল কায়েস ও তার স্ত্রী নাঈমা কায়েসের ব্যাপক প্রশংসা করেন সেলমিনহা। নাঈমা কায়েস তাদের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে তার স্কুলে অনুদান দিয়েছেন, নিয়মিত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।

মাদক সাম্রাজ্যে ভায়োলেন্সের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুদের স্বপ্নের জীবন দানে সবাইকে সহযোগিতার আহবান জানিয়ে সেলমিনহা বলেন, শুনেছি বাংলাদেশেও প্রচুর বিত্তবান আছেন, যারা নিয়মিতই চ্যারিটিতে দান করে থাকেন। বাংলানিউজের মাধ্যমে আমি ‘সিমেন্টে ডু আমানহা’র প্রতি তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মাদকের খপ্পর থেকে আমাদের বাচ্চাদের রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাই আমি।

উল্লেখ্য, কলম্বিয়ার ড্রাগ কিং হিসেবে পরিচিত পাবলো এস্কোভার সত্তর দশকের প্রথম দিকে লাতিন আমেরিকায় যে ড্রাগ ব্যবসার সূত্রপাত করেন, সেই ব্যবসাই এখন ব্রাজিলের বস্তি এলাকাগুলোকে রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিলিয়ন ডলারের এই ব্যবসায় রিও ডি জেনিরোর বস্তি এলাকার নিয়ন্ত্রক ড্রাগ ডিলাররা রাখছেন ব্যাপক ভূমিকা। এসব ড্রাগ ডিলার এতই শক্তিশালী যে, সরকারও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। প্রায় প্রতিদিনই এদের সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। এসব যুদ্ধে মারা যাচ্ছে অনেক নিরীহ মানুষ। ড্রাগ ডিলারদের  কারণে এই বস্তি বা ফাভেলাগুলো পরিণত হয়েছে অপরাধ সাম্রাজ্যে।

শিশুরা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সম্পৃক্ত হচ্ছে এইসব অপরাধে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদের আগামীর সম্ভাবনা। বস্তি শিশুদের এই সম্ভাবনা যাতে নষ্ট না হয়, সেলমিনহা’র ‘সিমেন্টে ডু আমানহা’ বা ‘আগামীর বীজ’ নামের এই স্কুলটি সেই সংগ্রামই চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংগ্রামে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিত্তবানদের সহযোগিতা চান সেলমিনহা। তিনি বলেন, রিও’র বস্তিগুলো বর্তমানে ড্রাগ ডিলার তৈরির কারখানা। আমি এটিকে আলোকিত মানুষ গড়ার কারখানা বানাতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ০১১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ