সেপিলক রিভার্জ ফরেস্ট (সান্দাকান) থেকে: মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে গাছের খোঁড়লে সেঁধিয়ে গেলো বোর্নিওর সূর্য ভাল্লুক। আশাহত হয়ে ফিরে আসার আয়োজন করতেই লতা-গুল্মের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আর একটা গাট্টা গোট্টা শরীর।
একটু দূরে আর একটা কালো শরীর উঁচু গাছ বেয়ে তরতরিয়ে নামছে। এদিকে আর একটা এসে যোগ দিলো আগেরটার সঙ্গে। তবে অবজারভেশন টাওয়ারে দাঁড়ানো জনা ছয় মানুষের দিকে খেলায় নেই তাদের। বুনো শুয়োরের মতো মাটি শুঁকে শুঁকে কি খুঁজছে কে জানে।
টাওয়ারে বসানো বায়নোকুলারটায় এখন আর কারো মনোযোগ নেই। চোখের সামনেই দু’দুটো ভাল্লুক আপনমনে চরছে। প্লাটফরমে দাঁড়ানো মানুষগুলোর দিকে মন নেই তাদের। যেনো ভাবছে, তাদের দেখতে মানুষ এসেছে, দেখুক।
পড়ে থাকা একটা গাছের খোঁড়লে মাথা সেঁধিয়ে বোধ হয় পোকা-মাকড় খুঁজলো একটা। আর একটা মাটিতে আসন পেতে বসে মাথা চুলকালো কিছুক্ষণ। তারপর একটা ঝোপের ভেতর ঢুকে বিশ্রামে বসলো বুঝি, আর বেরুলো না।
অপর ভাল্লুকটা গাছের গুঁড়িটার ওপর দিয়ে খাটো পায়ে অনায়াসে হেঁটে হারিয়ে গেলো ওপাশের বনে। গাছের খোঁড়লে লুকিয়ে পড়া সেই ভাল্লুকটা ফের ফিরে এসেছে। ওরা জানে, এটা তাদেরই অভয়ারণ্য, এখানে তাদের কেউ কিছু বলবে না। আর দর্শনার্থীদের দাঁড়ানোর ব্যবস্থা এতো উঁচুতে যে, ভাল্লুকগুলো তাদের নাগালই পাবে না।
এদের বলা হয় বোর্নিয়ান সান বিয়ার। এদের পাওয়া যায় কেবল এই বোর্নিও দ্বীপেই। ওরাংওটাং এর চেয়ে এদের দেখেই বেশী মজা পেলো সুইজারল্যান্ড থেকে আসা তরুণ ফটোগ্রাফার ফিলিপ। চোখের কাছে বলে তার ক্যামেরার চোঙ্গামতো লেন্সটা খুলে রেখেছে অনেক আগেই। শার্টারে ক্লিক করতে আরো বেশী মনোযোগী হলো সে।
বোর্নিয়ান এই সানবিয়ারের উচ্চতা ৪ থেকে ৫ ফুট। পুরুষগুলোর ওজন হয় ৩০ থেকে ৬০ কেজি। মেয়েগুলোর একটু কম। ২০ থেকে ৪০ কেজির মধ্যে। এদের লেজের দৈর্ঘ্য ২ ইঞ্চির বেশি নয়। চাপ দিয়ে ধরে নিমিষে মানুষ মেরে ফেলতে পারে এরা।
এদের আর একটা প্রজাতি আছে মালয়ান সানবিয়ার নামে। ওদের দেখা মেলে পূর্ব ভারত, দক্ষিণ চীন, কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয় উপদ্বীপ আর সুমাত্রার উপকূলীয় বনে। তবে বোর্নিয়ান সান বিয়ারের আকৃতি মালয়ান সানবিয়ারের অর্ধেক। খাদ্য ঘাটতির কারণেই এদের আকার এমন ছোট হয়ে এসেছে বলে বিশ্বাস করেন বিজ্ঞানীরা।
অধিকাংশ সময়ে গাছে গাছে ঘুরতেই পছন্দ করে সানবিয়ার। পোকা-মাকড় ছাড়াও বিছা, শুয়োপোকা আর মধু ভীষণ পছন্দ তাদের। মাটি খোঁড়ে বলে ওরা বনের কৃষক। আবার পোকা-মাকড় খেয়ে বাঁচিয়ে দেয় অনেক গাছকে। মৌচাকে হানা দিয়ে মধু খেয়ে চাক ফেলে রাখে কাঠবিড়ালী বা আর কোনো বুনোপ্রাণীর জন্য। একটা পুরুষ সান বিয়ারের খাবার খুঁজে বেঁচে থাকার জন্য অন্তত ১৫ বর্গকিলোমিটার বন প্রয়োজন হয়। তবে এখানে নিয়মিত তাদের খাবার সরবরাহ করে বন কর্মীরা। যদিও সান বিয়ারের খাবার খাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই।
এখানে তাদের মতো করেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই সেপিলক বনে। সান্দাকান থেকে এখানকার দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। আসতে হয় বাস বা ট্যাক্সিতে। যাওয়া-আসার ভাড়া ট্যাক্সিতে কিছুতেই ১শ’ রিঙ্গিতের (১ রিঙ্গিতে ১৯ টাকা) কম নয়। তবে সুলু সাগর তীরের টার্মিনাল থেকে বাস আসে এখানে। আর বাস মানে এখানে ১২ সিটের মাইক্রোবাস। সবই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ভাড়া পড়ে মাত্র ৬ রিঙ্গিত। এখানে ট্রিপ দেওয়ার বাসের নম্বর ১৪। দু’জন যাত্রী থাকলেও ঠিকই আসবে সময় মতো।
তবে কেউ কোটা কিনাবালু থেকে সরাসরি আসতে চাইলে সাড়ে ৫ ঘণ্টা সময় লাগবে ইনানাম টার্মিনাল থেকে। ভাড়া পড়বে ৪৩ রিঙ্গিত। নামতে হবে সেপিলক জংশনে। সেখান থেকে সান বিয়ার আর ওরাংওটাং সেন্টার আড়াই কিলোমিটার হাঁটা পথ। আর কেউ আকাশ পথে আসতে চাইলে কোটা কিনাবালু এয়ারপোর্ট থেকে সান্দাকান এয়ারপোর্ট নামতে সময় লাগবে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট। এয়ারপোর্ট থেকে সেপিলক সেন্টারের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। ভাড়া পড়বে ৩০ থেকে ৪০ রিঙ্গিত।
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৬
জেডএম/