ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

‘ইন্দোনেশিয়া যাবো, সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া’

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৭
‘ইন্দোনেশিয়া যাবো, সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া’ টুইন টাওয়ারের পেছনে পানির ফোয়ারা। ছবি: বাংলানিউজ

কুয়ালালামপুর (মালয়েশিয়া) থেকে: কুয়ালালামপুরে যেমন সকাল হলেও সূর্য ওঠে না, তেমনি সন্ধ্যে হলেও অাঁধার নামতে সাড়ে সাতটা পেরিয়ে যায়। টুইন টাওয়ারের সামনে ওয়াটার ফাউন্টেন শো দেখতে অাসা মানুষের ভিড়। কিছুক্ষণ পরেই পানির তালে অালো নাচতে শুরু করবে, ওই আলোর নিচে চাপা পড়ে আছে বাংলাদেশ থেকে অাসা অনেক মানুষের না জানার অজ্ঞতা, অনেক কষ্ট আর পরিশ্রমের বেদনা গাঁথা।

লেকের একদম সামনে বসে অাছি। পাশে এসে বসলেন একজন।

গা অার গড়ন বলে দেয় বাংলাদেশি। একটু পরেই ফোন বের করে ইমো অ্যাপসের মাধ্যমে লাউড স্পিকারে কথা বলা শুরু করলেন। স্পষ্ট চট্টগ্রামের ভাষা। 'হডে হডে' শব্দ উচ্চারণ বলে দিচ্ছে তার পরিচয়।

টুইন টাওয়ার।  ছোট-খাটো গড়ন। খুব কাছে বসায় কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি মোবাইলে অাসা ছবিগুলোও দেখা যাচ্ছে। কৌতুহলী কান অার চোখকে আরো কার্যকর করে তুললাম।

ইমোতে একটি কার্ডের ছবি এলো। সেটি পরখ করে নিচ্ছেন তিনি। বোঝা গেলো মালয়েশিয়ায় কোম্পানিতে কাজ করার কার্ডের মতো কিছু একটা। দেখেই অাবার পরমুহূর্তে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বলছেন, 'আগামী সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছি। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া। '

নিজের মনের মধ্যে অামার খচ করে উঠলো। কি বলছে! ২০১৩ সালে প্রথমবার মালয়েশিয়া এসে এক বাংলাদেশির ইন্দোনেশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার রোমহর্ষক বর্ণনা শুনেছিলাম।

প্রায় ১২ দিন ধরে তিমুর সাগর পাড়ি দিয়ে অাব্দুল হাই নামে সেই ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার তীরে পৌছেছিলেন। ৮ম দিনে ইঞ্জিন চালিত নৌকার তেলও শেষ হয়ে গিয়েছিল। খাবার আর পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। পানির সংকটে শরীর দূর্বল হয়ে পড়ছিল। একসময় গরমে আর ঘামে ভিজে যাওয়া শরীরের কাপঁড় চিপে তার লোনা পানি কয়েক ফোটা খেয়ে বাঁচতে হয়েছে। অনেকেই ক্ষুধার তাড়নায় কাপড় ছিড়ে চিবিয়েছে। শুধু আর কয়েক ঘণ্টা, কয়েক ঘণ্টা বলে সময় কাটিয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়া। তবে রাতের অাঁধার শেষ হলেও ভূখণ্ডের দেখা পাওয়া যায় না।  

১২ দিন পর যখন ভূখণ্ডের দেখা মেলে তখন সাগরের মাঝে পানি শূন্যতায় থাকা শরীর সাদা হয়ে এসেছে। আব্দুল হাই বলেন, মনে হয়েছিল বাঁচবো না। মরিনি, এই সান্ত্বনা এখন।

দালালদের প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ওই ভয়ংকর নৌ যাত্রায় নেমেছিলেন হাই। এরপর কি হলো? জানতে চাইলে বলেন, অস্ট্রেলিয়া কোস্ট গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে দেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করা অসম্ভব। আমাদের ধরে নিলো। ১ বছর জেল খাটার পর দেশে ফেরত পাঠালো। আবার অনেককে পাপুয়া নিউগিনি পাঠিয়ে দিলো। মালয়েশিয়ায় আসার জন্য খরচ করেছিলাম ৩ লাখ। আর এরপর অারো ৫ লাখ। সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার ওপর খরচ হয়েছে পরিবারের।

অাব্দুল হাই সেদিন কেঁদে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভাই অার কেউ যেন এই ভুল না করে।

অামার পাশে বসা ছটফটে তরুণের কাছে জানতে চাইলাম, ভাই কেমন অাছেন?

ভালো।

ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছেন শুনলাম।

এটুকু জিজ্ঞাসা করতেই কাজ সারা। মনে হলো শত্রু দেখলো। সন্দেহ অার ভীতির দৃষ্টিতে অামার দিকে তাকিয়ে মোটামুটি দৌড়ের বেগে হেঁটে তিনি পালিয়ে গেলেন বলা চলে।

স্পষ্টত তার অাচরণ বলে দিলো, বিষয়টি কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চান না তিনি।

অামার চোখে ভেসে উঠলো, অাবারো তিমুর সাগরে নৌকায় ভাসা এই বাংলাদেশির মুখ। ক্ষোভও হলো, এই মানুষরা নিজেদের এতো ‘চালাক’ ভাবে কেন!

মাজেদুল নয়ন

  মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

 

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৭
এমএন/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ