ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ছয় দশকে অস্তিত্বহীন দেড় শতাধিক নদী

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০২২
ছয় দশকে অস্তিত্বহীন দেড় শতাধিক নদী ফাইল ফটো

ঢাকা: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সঙ্গে রয়েছে দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য।

তবে কালের বিবর্তনে বিলিন হচ্ছে সে ইতিহাস। অব্যাহত দখলের কারণে প্রতি বছর বিলীন হচ্ছে নতুন নতুন নদী।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, দেশে নদী দখলদারের সংখ্যা ৩৯ হাজার ৫৫৮। দখলদারদের মধ্যে দেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, প্রতিষ্ঠান ও নামিদামি শিল্পগোষ্ঠীও রয়েছে। গত প্রায় ছয় দশকে সারাদেশে দেড় শতাধিক নদ-নদীর বিপন্ন দশা। এ দশার অন্যতম কারণ হলো- প্রাকৃতিক এ জলাভূমির ওপর দখলদারদের থাবা।  

এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ এবং নদীতে নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণও নদীগুলো ধ্বংসের আরেকটি কারণ বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

আলাদা দুটি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। যার অধিকাংশই মৃতপ্রায়। ‘বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরাম’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ১১৫টি নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। সংস্থাটি ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের নদ-নদী নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে ২০১০ সালে এ তথ্য প্রকাশ করে। ওই তালিকা তৈরির সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একদল গবেষক যুক্ত ছিলেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে এক দিকে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে পানি দূষিত হওয়ার কারণেও নদী মরে যাচ্ছে। অনেক নদীতে পানির প্রবাহ থাকলেও সেসব নদী এতমাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছে যে, সেখানকার পানি মোটেও ব্যবহারের উপযোগী নেই। মারাত্মক দূষিত নদীর তালিকায় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও বালুর শীর্ষে।

অপর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানিসম্পদসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উত্তরণ’।  

সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০ বছরে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে উপকূলীয় এলাকায় অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ, নদীতে পরিবেশবিনাশী বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ ও অবৈধ দখলকে দায়ী করেছে সংস্থাটি।

উত্তরণের তথ্য মতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা, শালিখা, শালিতা, হামকুড়া, চুনা ও হাতিটানার মতো তীব্র স্রোতের নদী এখন শুকিয়ে বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।

যদিও দেশে নদ-নদীর সঠিক সংখ্যা কতো- তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি কোনো দপ্তরেই নেই। ২০১১ সালে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শীর্ষক ছয় খণ্ডের একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে নদ-নদীর মোট সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল ৪০৫।  

তবে সরকারি এ তথ্যের সঙ্গে জোরালো দ্বিমত রয়েছে একাধিক বেসরকারি সংস্থা ও গবেষকদের। নাগরিক সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির দাবি, সারা দেশে ছোটবড় মিলিয়ে অন্তত ১২০০ নদী রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সিংহভাগের অস্তিত্ব বিপন্ন। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বহু নদী।  

দেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও নদ-নদী নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা এবং হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। তার লেখা গ্রন্থে ১ হাজার ৫১৬টি নদীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক গ্রন্থটি ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়।

এ ব্যাপারে প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলো জালের মতো বিস্তৃত, একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। তাই একটি নদী কোনো কারণে শুকিয়ে গেলে বা আরেকটির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তার প্রভাব অন্য নদীর ওপরে পড়ে।

এ পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে নদ-নদীতে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে এর পানিপ্রবাহের সঙ্গে পলির ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আবার যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। ষাটের দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ১০০ নদী শুকিয়ে গেছে। নদীগুলো রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি বলে মন্তব্য করেন প্রকৌশলী ম. ইনামুল।

নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বাংলানিউজকে বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে অধিকাংশ প্রভাবশালী নদী দখল করে আসছে। দখলদারদের বিরুদ্ধে একদিকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিচয়ে নদী দখলকারিদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০২২
টিএ/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।