ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সাবেক স্বামী হারুনের নির্দেশেই এনবিআর কর্মকর্তাকে অপহরণ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০২৩
সাবেক স্বামী হারুনের নির্দেশেই এনবিআর কর্মকর্তাকে অপহরণ গ্রেপ্তার তিন অপহরণকারী

ঢাকা: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাসুমা খাতুন নামের নারী যুগ্ম কর কমিশনারকে অপহরণের জন্য ৭০ হাজার টাকায় চাকরিচ্যুত গাড়ি চালককে ঠিক করেছিলেন ভুক্তভোগীর সাবেক স্বামী হারুন অর রশিদ।  একজন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিন ক্যাডার তিনি।

অপহরণের পর ভুক্তভোগীকে হাতিরঝিল থানা এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল অপহরণকারীদের। এই অপরহণের পর জায়গামতো পৌঁছে দেওয়া হলে অপহরণের হোতা মাসুম ওরফে মাসুদকে (৪২) বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়া হবে বলেও জানায় সাবেক স্বামী হারুন।  

গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে এসব তথ্য জানিয়েছেন অপরহণের মূলহোতা মো. মাসুম ওরফে মাসুদ ও তার সহযোগীরা।  

শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানিয়েছেন র‌্যাবে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।  

গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এ নারী যুগ্ম কর কমিশনারকে অপরহরণ করে দুর্বৃত্তরা। অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে এবং তিন অপহরণকারীকে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী।  

এ ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট ভুক্তভোগী বাদী হয়ে তার সাবেক গাড়িচালক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

এরপর র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এই অপহরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া এক মামলার প্রধান আসামি মাসুদ এবং তার সহযোগী মো. আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) ও মো. হাফিজ ওরফে শাহনিকে (৪৮) গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।  

র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‍্যাব-১ ও র‍্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।  

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার মাসুদ আগে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গাড়িরচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১ আগস্ট শৃঙ্খলাজনিত কারণে মাসুদা খাতুন তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। এতে মাসুমার প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আক্রশের সৃষ্টি হয় চাকরিচ্যুত মাসুদের।  

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার মাসুদ জানায়, চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ভুক্তভোগী মাসুমার প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদ। ভুক্তভোগীকে উচিত শিক্ষা দিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মাসুদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখান হারুন।  

তিনি বলেন, মাসুদ আরও জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে অগ্রীম ৭০ হাজার টাকা দেন হারুন। এই কাজের পরে তাকে আর ড্রাইভিং করতে হবে না ও উন্নত জীবন যাপন করার সকল ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও আশ্বাস দেন। পরে গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় মাসুদ তার সহযোগী হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানায় ও সবাইকে ৭০ হাজার টাকা বণ্টন করে দেয়। তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভুক্তভোগীর বর্তমান গাড়িচালকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হাফিজের সুসম্পর্ক ছিল। এই সুযোগে ভুক্তভোগীর অবস্থান গাড়িচালক থেকে জেনে মাসুদকে জানায় হাফিজ।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৭ আগস্ট রাত ৮টায় অপহরণকারীরা বেইলি রোড এলাকায় অবস্থান নেয়। রাত ৮টা ১৫ মিনিটে মগবাজার থেকে গাড়িযোগে বেইলি রোড এলাকায় পৌঁছালে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে মাসুমার গাড়ির গতিরোধ করে অপহরণচক্রটি। এসময় মাসুমার গাড়িচালক মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য নামলে তাকে মারধর করে এবং গ্রেপ্তার মাসুদ ড্রাইভিংসিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এসময় গ্রেপ্তার পনুসহ অন্যান্য সহযোগীরা গাড়িতে উঠে বসে মাসুমাকে অপহরণ করে হাতিরঝিলের উদ্দেশ্যে যায় এবং অপহরণের বিষয়টি মাসুমার প্রথম স্বামী হারুনকে জানায়। তখন হারুন তাদের হাতিরঝিলে একটি বাসার ঠিকানা বলে দেয় এবং মাসুমাকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ওই বাসার গেইট বন্ধ পাওয়ায় মাসুমাকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।  

তিনি বলেন, পরে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় গ্রেপ্তার মাসুদের পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। এবং তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় বলে ভুক্তভোগী মাসুমা অভিযোগ করেন।  

পরে তাকে ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে জুমা পর্যন্ত অবস্থান করে। এ সময় হারুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জুমার পর সেখানে নিয়ে যেতে বলেন তিনি। পরে দুপুরে খাবার সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যায় এবং পনু, সাইফুল ও শাস্ত গাড়ি পাহারায় থাকেন। এসময় সুযোগ বুঝে মাসুমা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করে। এসময় মাসুদ, পনু ও শান্ত কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে মাসুমাকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেপ্তার করে তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার মাসুদ বিগত ২৫ বছর ধরে গাড়ি চালান। ইতোপূর্বে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী যানবাহন চালিয়েছেন তিনি। বাস চালানোর সময় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজনের নিহতের ঘটনায় তার নামে মামলা হলে তার ভারী যান চালানোর লাইসেন্সটি বাতিল হয়। এছাড়াও তিনি গাড়ি চুরিসহ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়।  

এনবিআর কর্মকর্তা অপহরণ ঘটনার পর মাসুদ রাজধানীর বাবু বাজার এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় এবং গাজীপুর শ্রীপুর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা থেকে মাসুদকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

গ্রেপ্তার পনু পেশায় একজন সিএনজিচালক। একই এলাকায় বসবাস করার কারণে মাসুদের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই অপহরণের ঘটনায় মাসুদ তাকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা অগ্রীম দেন। গ্রেপ্তার হাফিজ দূরপাল্লার বাস চালাতেন। ২০২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে তার চাকরি চলে যায়। একই পেশা এবং একই এলাকায় বসবাসের কারণে মাসুদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। এই অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার মাসুদ তাকে ৫ হাজার টাকা অগ্রীম দেন।

গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং পলাতক আসামি শান্তকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলেও জানান র‌্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।  

যদি ভুক্তভোগীর আগের স্বামীর নির্দেশে এই অপহরণের ঘটনা ঘটে তবে তাকে কেন গ্রেপ্তার  করা হচ্ছে না? 

সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি মাসুদ জানিয়েছেন, তার পূর্বের ক্ষোভ ছিল এবং মাসুমার আগের স্বামীর প্রলোভনে পড়ে এই অপহরণে ঘটনা ঘটায় তারা। তাদের দেওয়া এসব তথ্য ভুক্তভোগীর করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জানানো হবে। আসামির দেওয়া যাচাই-বাছাইয়ের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

তিনি বলেন, অপহরণের পর আসামি মাসুদ বারবার ভুক্তভোগীর সাবেক স্বামীর মোবাইল ফোনে কল করে বিষয়টি জানায়।  

আরও পড়ুন >> অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর মুক্ত এনবিআরের যুগ্ম কমিশনার

                  >> এনবিআর কর্মকর্তাকে রাতভর নির্যাতন: গাড়িচালক মাসুদকে খুঁজছে পুলিশ

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০২৩
এসজেএ/এসএএইচ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।