ফরিদপুর: সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজা গত ৯ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও মন্দিরে মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভিড় জমেছে অষ্টমীর দিন থেকে। এ বছর ফরিদপুর জেলায় ৭২৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে।
রোববার (১৩ অক্টোবর) বিসর্জনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসব শেষ হলেও আলফাডাঙ্গার ২৫১ প্রতিমাগুলো দশমীর পরে আরও এক সপ্তাহ (১৭ অক্টোবর পর্যন্ত) দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটি। শারদীয় দুর্গোৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স কাজ করছে। পাশাপাশি প্রতিটা মণ্ডপে আনসার ভিডিপির সদস্যরা নিরাপত্তায় কাজ করছেন। এছাড়া মন্দিরে নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকও রয়েছেন।
সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শ্রী শ্রী হরি মন্দিরে সনাতন ধর্মের চার যুগের দেব-দেবীদের জীবনকাহিনি নিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে ২৫১টি প্রতিমার বিশাল প্রদর্শনী। মন্দিরের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে কাশবন, ছোট পুকুরে ঝর্না ও সাজসজ্জা। প্রতিমা দেখার পাশাপাশি এগুলো দেখে সবারই মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই প্রতিমা দেখতে জেলা সদরসহ আশপাশের জেলা থেকে আসছেন দর্শনার্থীরা। এ ধরনের প্রতিমা দেখে খুশিতে আত্মহারা দর্শনার্থীরা। হরি মন্দিরের এত বড় মণ্ডপের আয়োজন শুধু জেলা-উপজেলায় নয়, সাড়া ফেলেছে আশপাশের জেলাগুলোতেও।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসছেন এ প্রতিমা দেখতে। গত ৯ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও মন্দিরে মন্দিরে দর্শনার্থীদের বেশি আগমন ঘটেছে অষ্টমীর দিন রাত থেকে। নবমীর দিনেও সকাল থেকে মন্দিরস্থলে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
পূজা মণ্ডপে আসা দর্শনার্থীরা জানান, কয়েক বছর ধরে এখানে দুর্গোৎসবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিমা তৈরি করা হয়। প্রতিমাগুলো দেখে আমাদের সনাতনী ধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করি। আমরা এসে অনেক আনন্দ উপভোগ করি। আমরা শান্তিতে সুন্দরভাবে বিভিন্ন এলাকা গিয়ে পূজা উদযাপন করতে পারছি।
তারা জানান, দেবী দুর্গতিনাশিনীর আগমনে সব অশুভ অপশক্তির বিনাশ হয়ে সত্য-সুন্দর-সম্প্রীতির বাংলাদেশ হবে দুর্গোৎসবে এমন প্রত্যাশায় আমাদের।
দর্শনার্থী দোদুল কুণ্ডু জানান, শ্রী শ্রী হরি মন্দিরে এসে প্রতিমা প্রদর্শনী দেখে আমাদের শাস্ত্রে বর্ণিত ইতিহাস ও কাহিনি সম্পর্কে সহজেই বুঝতে পারি। শারদীয় দুর্গোৎসবে আমাদের ভেতরের আশ্বরিক প্রগতি দূর করতে পারি। আর বাইরের আশ্বরিক প্রগতি যাতে ধ্বংস হয় মার কাছে আমাদের এটা প্রার্থনা।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে আসা পূজা নামে এক শিক্ষার্থী জানান, এ জায়গা এসে অনেক ভালো লাগছে। অন্য জায়গা একটা দুইটা প্রতিমা থাকে আর এখানে এসে আমরা ২৫১টি প্রমিমা দেখতে পারছি। সবাই যাতে সারা বছর সাবধানে নিরাপদে থাকতে পারে দুর্গোৎসবে আমার এ কামনা।
ভারত থেকে ভিসা নিয়ে আসা দক্ষ প্রতিমা কারিগর মৃৎশিল্পী অনিল কুমার জানান, পূজার সময় আমাদের ব্যাপক ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রতিমা গড়া, রং-তুলির কাজ খুব সূক্ষ্ম-সুনিপুণ হাতে করা হয়েছে।
তিনি জানান, দেব-দেবীর মূর্তি তৈরির সঙ্গে আমাদের অনুভূতি, ভক্তি ও শ্রদ্ধা জড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ প্রতিমা তৈরির পরে যখন মণ্ডপে বসানোর সময় অন্তরে প্রশান্তির অস্তিত্ব টের পাই। আর দর্শনার্থীরা যখন প্রশংসা করে তখন মনটা খুশিতে ভরে যায়।
আলফাডাঙ্গা হরি মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক ও পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি কলেজশিক্ষক প্রবীর কুমার বিশ্বাস জানান, সনাতনীদের ধর্মীয় কাহিনি সহজভাবে বোঝানোর জন্য প্রতিমাগুলো তৈরি করা হয়েছে। যেটা বই-পুস্তক পড়ে বুঝতে অনেক সময় লাগে। এ প্রতিমা নির্মাণ করতে সময় লেগেছে সাড়ে তিন মাস। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে এসে নির্মাণ করেছেন মৃৎশিল্পী অনিল কুমার পাল। আশা করি, বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থীরা আনন্দ পাবেন। অষ্টমীর দিন রাত থেকে অনেক ভক্তদের সমাগম শুরু হয়েছে। প্রদর্শনীগুলো দশমীর পরেও এক সপ্তাহ থাকবে। প্রতিমা তৈরি, ডেকোরেশন, লাইটিং, সাজসজ্জাসহ খরচ হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এ টাকা সবার সহযোগিতায় জোগাড় করা হয়ে থাকে।
আলফাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন অর রশিদ বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফরিদপুর জেলার মধ্যে আলফাডাঙ্গা হরি মন্দিরেই সবচেয়ে বড় দুর্গাপূজা উদযাপন হচ্ছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে আনসার সদস্যদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করছেন। সব পূজামণ্ডপগুলো গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমীন ইয়াসমীন জানান, দুর্গাপূজায় আলফাডাঙ্গায় একই মন্দিরে ২৫১টি প্রতিমার প্রদশর্নী তৈরি করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সার্বক্ষণিক আটজন আনসার সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। এখানে নারী-পুরুষের জন্য প্রবেশপথ আলাদাভাবে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে নামাজের সময় গান, বাজনা ও ঢাকঢোল বন্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছে। মন্দিরগুলোর নিরাপত্তায় প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিশেষভাবে কাজ করছে। সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০২৪
আরবি