ঢাকা: জেলখানা সংক্রান্ত আইন ও বিধি সংস্কারের কথা উল্লেখ করে শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, দুই বার জেল ভিজিটের সুযোগ হয়েছিলো। তবে সেটা বন্দি হিসেবে।
শনিবার কারা অধিদপ্তরে 'কারাগার সংস্কার : বাস্তবতা ও করণীয়' শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। আইন, আদালত, মানবাধিকার ও সংবিধান বিষয়ক সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন ল' রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) ও কারা অধিদপ্তর যৌথভাবে এ কর্মশালা আয়োজন করে। এতে সহযোগীতা করে ল’ ল্যাব। কর্মশালায় জেল সংস্কার : সম সাময়িক প্রেক্ষাপট ও প্রস্তাবনা বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
শিল্প উপদেষ্টা বলেন, দুইবার জেল ভিজিটের সুযোগ হয়েছিলো,ওইখানকার বন্দি হিসেবে। প্রথমবার রাতে তুলে নেওয়ার পর কিছুটা সময় নিখোঁজ থাকার পার রিমান্ড হয়ে যখন জেলে পৌঁছালাম তখন একটা অভিজ্ঞতা। এরপর যখন দুই বছরের সাজা নিয়ে মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশের কারণে জেলে গেলাম তখন আরেকটা অভিজ্ঞতা।
জেলখানার সমস্যার সমাধান নিয়ে আদিলুর রহমান খান বলেন, বিচারপতি শাহ আবু নাইম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশনে কারা বিষয়ক আইনগুলোর আধুনিকায়নে পরিবর্তনের সুযোগ আছে।
জেলখানার ভেতেরের সমস্যা নিয়ে তিনি আরও বলেন, আমি একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, আমাদের উকিলরা যখন দেখা করতে আসতেন। খুব কষ্ট হতো। কথা বলা, আইনগত পরমার্শ, এদিকটা অবিলম্বে সমাধান করার দরকার। যারা কারাগারে থাকে তাদের আইনগত পরামর্শ লাগে। এই জায়গা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনারা দেখবেন।
প্রধান অতিথি আদিলুর রহমান খান আরও বলেন, সবাই মিলে আমরা একটি পরিবার। কারাগার-আদালত সর্বোপরি সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে একসঙ্গে আমাদেরকে উদ্যোগ নিতে হবে। আলাদাভাবে সম্ভব না। কারাগারের সংস্কারের জন্য একসঙ্গে চেষ্টা করতে হবে। আদালতগুলোতে যেন নির্যাতিত মানুষের সংখ্যা কমে আসে। বিচারগুলো যেন হয়।
এলআরএফ এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদের সভাপতিত্বে কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বিচারপতি মো.রুহুল কুদ্দুস, সিনিয়র অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ, রুহুল কুদ্দুস কাজল, কারা মহাপরিদর্শক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো.মোতাহার হোসেন, সাবেক কারা উপ মহাপিরদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী, কারা উপ মহাপরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাফিউল আলম , যুগ্ম জেলা জজ মতিউর রহমান, জিআইজেড প্রতিনিধি মার্টিনা বুরকার্ড প্রমূখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রশিক্ষণ ও কল্যান সম্পাদক জাবেদ আখতার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায়ের সমালোচনা করার অধিকার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে। একাডেমিক আলোচনা কোনটা, কল্যাণার্থে আলোচনা কোনটা আর আদালত অবমাননা কোনটা-এর পার্থক্য আমাদের বুঝতে হবে। রায়ের সমালোচনা একাডেমিক উদ্দেশ্যে, কল্যাণার্থে এবং সংশোধনের উদ্দেশ্যে সব সময়ই করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি।
বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, বিভিন্ন সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে কারা সংস্কারে উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে কারাগার আমাদের সমাজেরই অংশ। কারাবন্দী একজন মানুষের শুধু ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট থাকবে না। তার ভোটাধিকার বা কথা বলার অধকার কেন থাকবে না? এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। কারাবন্দীদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য যা প্রয়োজন করতে হবে। দণ্ডিত মায়েদের সন্তানদের লেখা-পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, কারা আইন সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। মানবিকভাবে কারাগার গুলোকে গড়ে তুলতে হবে। জেল কোড ও ফোজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে যুগোপযোগী করা এখন সময়ের দাবি। কারাগারে দুর্নীতির সিন্ডিকেট রয়েছে। কারাগারে অবৈধভাবে সেবা কেনার সুযোগ আছে। সেগুলো বন্ধ করতে হবে। কারণ বন্দীরা সবাই সমান।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহার হোসেন বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ১৭ টি কারাগারে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে সব কারাগারে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দেশের সব কারাগারে এখন নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশ রয়েছে।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধে মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, কারগার মূলত সংশোধানাগার। কারাগারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধীর সংস্কার বা সংশোধন। জেলগুলো মূলত ১৮৬০ সালের জেল কোড, দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট ও দ্য প্রিজনার্স অ্যাক্ট আইনসমূহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব আইন ঔপনিবেশিক আমলের। এসব আইন সংশোধন করে জেল ব্যবস্থা সংস্কার এখন সময়ের দাবি। তিনি আইনগত কাঠামো ও যুগোপযোগী, ডাটাবেজ সংরক্ষণ ও বায়োমেট্রিক পদ্ধতি, চিকিৎসা সেবা ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ সংক্রান্ত আইন আরও যুগোপযোগী করতে প্রস্তাব করেন। সেইসঙ্গে খাদ্যের মান বৃদ্ধি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ, নারী, শিশু ও প্রবীণ বন্দিদের অধিকার নিশ্চিত করা, পরিবার ও সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চিত করা, কর্মসুবিধা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম, প্রজননের অধিকার নিশ্চিত করা এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রস্তাব করেন। শিশির মনির বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কনডেম সেলে এবং কারাগারে নির্জন স্থানে রাখা আইনের লংঘন। চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কনডেম সেলে রাখা যাবেনা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯,২০২৪
ইএস/এমএম