ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ মাঘ ১৪৩১, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

এই সময়ে হাসিনার ভাষণের সিদ্ধান্তই উসকানিমূলক: ফরহাদ মজহার

নিউজ ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫
এই সময়ে হাসিনার ভাষণের সিদ্ধান্তই উসকানিমূলক: ফরহাদ মজহার ফরহাদ মজহার

রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বিক্ষব্ধ ছাত্র-জনতার ভেঙে দেওয়া প্রসঙ্গে বুদ্ধিজীবী ও লেখক ফরহাদ মজহার বলেছেন, এই উসকানি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা দিয়েছেন। এই সময়ের তার ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্তই ছিল উসকানিমূলক।

বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন। ফরহাদ মজহার এই বাড়ি ভাঙার ঘটনাকে আওয়ামী লীগের বৈশ্বিক পরিসরে প্রদর্শনের ওপর নজর রাখারও তাগিদ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙার উস্কানি শেখ হাসিনা স্বয়ং দিয়েছেন, এই সময়ে তার ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্তই ছিল উসকানিমূলক। হাসিনার মাথায় রয়েছে ফেব্রুয়ারিতে (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট) ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশ নিয়ে ইন্দো-মার্কিন-ইসরায়েলি আঞ্চলিক পরিকল্পনা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অলিগার্কি, অর্থাৎ অল্প কিছু বিলিয়নারদের আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা। যেমন ইলন মাস্ক, জুকারবার্গ, বিল গেটস প্রমুখ। এর কুফলও বাংলাদেশসহ গরিব ও প্রান্তিক দেশগুলোতে পড়বে। হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে মার্কিন বর্ণবাদী গোষ্ঠীর মৈত্রীও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্পের গাজানীতি ভয়াবহ। ইতোমধ্যে ট্রাম্প বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গাজার ‘নিয়ন্ত্রণ নেবে’ এবং এর ওপর তার ‘মালিকানা’ প্রতিষ্ঠা করবে। ”

ফরহাদ মজহার বলেন, “এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাষণ বুঝতে হবে। নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি রাজনীতির যে ছক কষছেন সেদিকে আমাদের পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ রাখতে হবে। ছাত্র-জনতার ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভের পরিণতি হচ্ছে ৩২ নম্বর ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া। এটা শুরু, শেষ নয়। আমরা দেখলাম একে রক্ষা করার কোনো পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেনি। সেনাবাহিনী কিছুক্ষণের জন্য এলেও ফিরে গেছে। জনগণের বিপরীতে সেনাবাহিনীকে দাঁড় না করাবার নীতি সঠিক। ”

‘কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে দিল্লি প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে জানমাল রক্ষা করতে উপদেষ্টা সরকার ব্যর্থ। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাখ্যা করা হবে যে বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার নেই। এটাই দিল্লি হাসিনার পক্ষে প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করবে। দিল্লি দাবি করবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ফলে দিল্লি আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা করতে পারে। এই বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে। যদি আমরা সামনের দিনে আরও গভীর সংকটে পতিত হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে চাই তাহলে অবিলম্বে শেখ হাসিনার সংবিধান বাতিল করে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করুন, নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করুন। এটা পরিষ্কার, ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখার শপথ করে আমরা আদতে ফ্যসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম রেখেছি। এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাড়ি ভাঙলাম অথচ শেখ হাসিনার বানানো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি কায়েম রাখলাম এটা কি হয়!’

ফরহাদ মজহার বলেন, অতএব পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা যেন কোনো গভীর সংকটে না পড়ি সেজন্য এখনই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের ক্ষোভকে আমলে নিতে শিখুন। ছাই দিয়ে আগুন নেভানো যায় না। ’

নিজের পোস্টে মোহাম্মদ রোমেল নামে একজনের একটি পোস্ট উল্লেখ করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি আরও বিস্তারিত বুঝবার জন্য মোহাম্মদ রোমেলের পোস্টটি দেখুন। ’

রোমেলের পোস্টে বলা হয়েছে, “শেখ হাসিনার ভাষণের বিরোধিতায় ৩২ নাম্বার ভাঙার ফলে বাংলাদেশের জনগণের এই মুহূর্তে কোন লাভ হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। তাইলে ৩২ নাম্বার ভাঙার রাজনীতি কী? এই রাজনীতিতে কে কী অর্জন করলো? এর পর্যালোচনা দরকার। দেশে-বিদেশে এর প্রভাব কী পড়বে সেইটারও পর্যালোচনা দরকার। এই মুহূর্তে জরুরি প্রশ্ন হলো, জনতা এইটা ভাঙতে গেল কেন? উত্তেজিত না হয়ে, কোনো পক্ষ না নিয়ে ঠান্ডা মাথায় আমাদের এর কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি । আমার মনে কয়েকটা কারণের কথা আসছে। সেইসব শেয়ার করি।

১) হাসিনার আজকে ভাষণ এবং তার দলের মাসব্যাপী কর্মসূচিতে জনগণ ভীত হয়েছে। ভাবছে এর পেছনে ভারতের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। ফলে তাদের প্রতিরোধের অংশ আকারে জনতা ৩২ নাম্বারে গেছে।

২) হাসিনা এবং তাদের দলের কারও মধ্যেই এখন পর্যন্ত তাদের অতীত খুন-গুম-লুটপাট-বিচারহীনতা নিয়া কোনো সরি ফিলিং মানুষ দেখছে না। ফলে মানুষের মনে তাদের বিষয়ে ক্ষোভ কমেনি। বরং তারা ফিরে আসার নানান হুমকি দিচ্ছে। দোষ অস্বীকার করছে। এইটাও জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।

৩) হাসিনা তার পুরো শাসন আমলে তার বাপকে সামনে রেখে, দেবতা বানিয়ে তার সমস্ত অপকর্ম করে গেছে। ফলে ইতিহাসের শেখ মুজিবুর আর হাসিনার বানানো ফ্যাসিস্ট আইকন শেখ মুজিবুরের পার্থক্য জনগণের মধ্যে এখন আর নেই। ফলে ৩২ নাম্বারকে জনগণ ফ্যাসিস্ট আস্তানা হিসাবে দেখছে। ফলে এইটা ভাঙতে গেছে।

৪) ৫ আগস্ট সরকার গঠনের পর এখন পর্যন্ত ফ্যাসিস্টদের বিচার শুরু হয়নি। বড় বড় নেতাদের অনেকেই পালিয়ে গেছে। ‌ দেশে যারা আছে তারাও গ্রেফতার হয়নি। গ্রেফতার হওয়ার কোনো ভরসাও সরকারের তরফ থেকে পাচ্ছে না। ফলে মানুষের মধ্যে চরম হতাশা আছে।

৫) এখন পর্যন্ত তরুণরা যে যে দাবি নিয়ে মাঠে হাজির হয়েছিলেন তার একটাও পূরণ হয়নি। তারা চুপ্পুকে (রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন) অপসারণ করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। নতুন সংবিধান/গঠনতন্ত্রের কথা বলছিলেন। সেটাও হচ্ছে না। তারা ‘জুলাই ইশতেহার ঘোষণা’ করতে চেয়েছে। সেটাও পারেনি। ফলে যেন একটা অর্জনহীন সময় চলে যাচ্ছে।

৬) দেশের কোথাও কোনো সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি সরকার। ফলে জনগণ ক্ষুব্ধ। আমলাতন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে না। ফলে জনগণ ক্ষুব্ধ। পুলিশ কাজ করছে না। ফলে জণগণ ক্ষুব্ধ। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। ফলে জণগণ ক্ষুব্ধ। এর প্রকাশ ৩২ নাম্বারে দেখছি।

৭) দেশের অর্থনীতি এখনো গতি পায় নাই। ফলে জনগণ ক্ষুব্ধ।  

৮) জনগণের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো পরিষ্কার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিশা নেই। ফলে তারা অস্থির দিশেহারা। এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পর এত এত ফেইলরে খুব স্বাভাবিকভাবেই আগস্ট বিপ্লবীরা হতাশ। এই হতাশা নিয়ে জনগণ নিশ্চয় ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে না। ফলে ফ্যাসিস্টদের বাড়াবাড়ির সুযোগে‌ তারা আবার বের হয়ে আসছে। সেই ক্ষোভ মিটাইতে আজকে (বুধবার রাতে) তারা ৩২ নাম্বার ভাঙতে গেছে।

আমি নিশ্চিত সরকার যদি ঠিকঠাক ফাংশন করতো এবং ফ্যাসিস্টদের বিচার চলতো, তাইলে মানুষ আজকে ৩২ নাম্বারে গিয়ে অনাহুত এই ক্ষোভ প্রকাশ করতো না। তাদের প্রত্যাশা এবং হতাশাকে যদি আগামী দিনে আমরা যথাযথ পথে পরিচালিত করতে চাই, তাইলে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেন। সরকার কীভাবে আরও ফাংশনাল করা যায় সেই ব্যবস্থা করেন। ফ্যাসিস্টদের বিচার দ্রুত শুরু করেন। জুলাইয়ে আহতদের দিকে মনোযোগ দিন। সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নেন। আমলাতন্ত্রকে টাইট দেন। দরকার হয় পুরো উপদেষ্টা পরিষদ নতুন করে সাজান। আন্দোলনে যুক্ত সব পক্ষের বিপ্লবীদের সঙ্গে নিয়মিত ডায়ালগ করেন। তাদের পরামর্শ শোনেন। সঠিক পরামর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। তাদের নতুন রাজনৈতিক দিশা দেন। নাইলে এই অভূতপূর্ব শক্তির অপচয় এবং অপব্যবহার হবে। হবেই। ঠেকাতে পারবেন না। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।