আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ ছিল একটি লুটতন্ত্র, মাফিয়াতন্ত্র। প্রতিটি সংসদীয় এলাকা একজন করে মাফিয়ার কাছে জিম্মি ছিল।
নারায়ণগঞ্জে যেমন মাফিয়া সর্দার ছিলেন শামীম ওসমান, রূপগঞ্জে ছিলেন গাজী গোলাম দস্তগীর, জামালপুরে মির্জা আজম, টাঙ্গাইলে ছোট মনির, নোয়াখালীতে একরামুল করিম চৌধুরী, মাগুরায় শিখর, ফেনীতে নিজাম হাজারী, কুমিল্লায় তাজুল ইসলাম, চট্টগ্রামে সাইফুজ্জামান চৌধুরী, কক্সবাজারে বদি। এভাবে সারা দেশকে যেন ৩০০টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটি এলাকায় একজন গডফাদার ছিলেন। দেশের পুলিশবাহিনীকে করা হয়েছিল তাদের অনুগত। এ মাফিয়াতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে কামাল প্রথমে হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু দ্রুতই তিনি তাঁর মাফিয়া নেটওয়ার্কের মন জয় করে ফেলতে পারেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বুঝিয়ে দেন যে তিনি আসলে জনগণের সেবক হবেন না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাঁর নয়, বরং তিনি আসলে আওয়ামী সন্ত্রাসী, লুটপাটকারী এবং মাদক কারবারিদের রক্ষা করবেন। তারা যেন অবাধে লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়তে এবং বিদেশে সম্পদ পাচার করতে পারে তা নিশ্চিত করা ছিল আসাদুজ্জামান খানের প্রথম লক্ষ্য। এ কারণেই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী হন। আওয়ামী লীগের ইতিহাসে তো নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এত দ্রুত প্রতিমন্ত্রী থেকে কেউ পূর্ণমন্ত্রী হতে পারেননি। পূর্ণমন্ত্রী হওয়ার পর আসাদুজ্জামান খান বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব করেছিলেন। গোটা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লুটতন্ত্র, মাফিয়াতন্ত্র।
আসাদুজ্জামান খানের অপকর্ম ছিল কয়েক ভাগে বিভক্ত। প্রথমত তিনি যতরকম পুলিশ নিয়োগ, পোস্টিং হতো সবকটি থেকে নিয়মিত অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী যেমন আনসার নিয়োগ এবং বদলিতে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করতেন। এসব সংস্থায় নতুন যে নিয়োগগুলো হতো, সেগুলোয় তিনি মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন। মেধা বা পরীক্ষার ভিত্তিতে নয়, কামালের একটি তালিকার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব নিয়োগ হতো। সে তালিকায় যে শুধু কামালের পছন্দের ব্যক্তি থাকত এমনটি নয়, সারা দেশে যে মাফিয়াচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে চক্রের লোকেরা পাঠাত তালিকা এবং বস্তা ভর্তি টাকা। সে টাকা এবং তালিকা অনুযায়ী কাজ করতেন কামাল। ফলে আস্তে আস্তে কামালের রাজত্বে অল্প সময়ের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার নিরপেক্ষতা হারায়। পুলিশবাহিনী পরিণত হয় আওয়ামী পুলিশবাহিনীতে। র্যাব পরিণত হয় নিষ্পেষণের যন্ত্র হিসেবে। এ ছাড়া কামাল গড়ে তোলেন ‘আওয়ামী বাহিনী’।
আসাদুজ্জামান খানের আরেকটি অপকর্ম ছিল বিরোধীমত দমন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করে জঙ্গিবাদ দমনের নামে আলেমওলামাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তাদের জঙ্গি বানিয়ে জঙ্গি অভিযানের নাটক সাজান এবং এসব নাটকের মাধ্যমে বহু মানুষকে হত্যা করেন। একদিকে যেমন কামাল ক্রসফায়ার প্রথা চালু করেছিলেন, যেখানেই বিরুদ্ধমত হবে, সেখানেই ক্রসফায়ারের মাধ্যমে তাদের হত্যা করা হবে, অন্যদিকে তিনি চালু করেছিলেন জঙ্গি নাটক। এসব জঙ্গি নাটকের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে দমন করা ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য।
বিরোধীমত দমনের জন্য গুম, হত্যা, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যারাই কামাল বা তাঁর মাফিয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাদের বিরুদ্ধেই নেমে আসত খড়্গ। আমরা সবাই ইলিয়াস আলী গুমের কথা জানি। ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছিল শুধু এ মাফিয়াতন্ত্রের বিরোধিতা করার জন্য। শুধু তাই নয়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকেও গুম করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তাঁকে ভারতে ফেলে রেখে আসা হয়। সেখান থেকে ভারতীয় বাহিনী তাঁকে উদ্ধার করে।
বসুন্ধরা মিডিয়া এ সময় আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে প্রথম সোচ্চার হয়। সারা দেশে বিভিন্ন আওয়ামী সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে বসুন্ধরা গ্রুপই প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। এসব প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে বসুন্ধরাকে সরাসরি হুমকি দেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বসুন্ধরা মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। শুধু তাই নয়, এ সময় বসুন্ধরা গ্রুপকেও ‘আয়নাঘরে’ পাঠানো হবে, গুম করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। এভাবে যারাই কামালের মাফিয়া নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো কথা বলেছেন, তাদের নিগৃহীত হতে হয়েছে। কামাল তাঁর দুর্নীতি, অপকর্ম, লুটপাট ইত্যাদি বাধাহীনভাবে করার জন্য শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আস্থাভাজন হওয়ার জন্য তিনি ‘কসাই কামাল’ হিসেবে আবির্ভূত হন এবং নির্মমভাবে বিরোধী পক্ষের ওপর দমনপীড়ন শুরু করেন। বিরোধী পক্ষের ওপর একের পর এক মামলা-হামলা করে তাদের জেলে পোরার রেকর্ড তৈরি করেন কামাল। কামালই হলেন প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি ‘গায়েবি মামলা’র সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। মামলা করতে গিয়ে তিনি এমনই বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন যে কে বেঁচে আছে, কে মারা গেছে সে খেয়ালও রাখতে পারতেন না। এমনকি মৃত ব্যক্তিকেও হত্যা মামলার আসামি বানিয়েছিলেন কামাল।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কামাল তাঁর ১০ বছরের শাসনামলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ২৭ হাজার মামলা করেছিলেন সারা দেশে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এসব মামলাই ছিল বানোয়াট, মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হননি এমন কোনো বিএনপি নেতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে একদম স্থানীয় পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত কামালের নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
সারা দেশে কামালের নেটওয়ার্কের মূল উৎস ছিলেন প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত মাফিয়া গডফাদাররা। তারা যেসব তথ্য দিতেন, যাকে গ্রেপ্তার করতে বলতেন কামাল পুলিশবাহিনীকে তাদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিতেন। এভাবে সারা দেশে একদিকে যেমন লুটপাট, সন্ত্রাস এবং মাদক কারবার রমরমা করা হয়েছিল, অন্যদিকে বিরোধী দল যেন কোনোভাবে গণতন্ত্রের জন্য, তাদের অধিকারের জন্য প্রতিবাদ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হয়েছিল ভোটারবিহীন মাফিয়া এমপিদের কাছে। আসাদুজ্জামান খান কামালের এ রাজত্বে আইনশৃঙ্খলা বলে কোনো কিছু ছিল না। পুরো দেশ পরিণত হয়েছিল একটি সন্ত্রাসের জনপদে। সন্ত্রাসীরাই এখানে বুক চিতিয়ে ঘুরত। যারা নিরীহ নাগরিক, তারা ভয়ে কুণ্ঠিত অবস্থায় থাকত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আসাদুজ্জামান খান কামালের আরেকটি বড় অপকর্ম হলো তিনি ছাত্রলীগ, যুবলীগকে অকাতরে অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কামালের ১০ বছরের মন্ত্রিত্বের সময় প্রায় ৩২ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সবই দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ক্যাডারদের। বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের জন্য এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এ সময় কামাল অবৈধ অস্ত্র হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ, যুবলীগের হাতে। বিভিন্ন সময় পুলিশ যখন এ অবৈধ অস্ত্রের কথা বলত, তখন তিনি তাদের এসব বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামানোর নির্দেশনা দিতেন। আর এর ফলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে একদিকে যেমন পুলিশবাহিনী কাজ করত, নির্বিচার গুলি চালাত, হত্যা-গুম করত; অন্যদিকে কামালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ‘হেলমেট বাহিনী’। যারা মূলত আওয়ামী সন্ত্রাসী, তারা বিরোধী দলের ওপর চড়াও হতো। এভাবেই একটি ‘প্যারালাল সন্ত্রাসী বাহিনী’ তৈরি করেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজ হলো ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালন’; কিন্তু কামালের রাজত্বে ছিল ‘দুষ্টের লালন, শিষ্টের দমন’।
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন