ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৭ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

বিশেষ লেখা

আরাফাত রহমান কোকো: এক নিভৃতচারী অমর ক্রীড়াশিল্পী

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৮:৫২, আগস্ট ১২, ২০২৫
আরাফাত রহমান কোকো: এক নিভৃতচারী অমর ক্রীড়াশিল্পী আরাফাত রহমান কোকো

আরাফাত রহমান কোকো। পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন ১৯৬৯ সালে।

বাবার কর্মস্থল ছিল কুমিল্লায়। জন্মের পরপরই আসে একাত্তর।

মুক্তিযুদ্ধে চলে যান বাবা। চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। তারপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

একটি স্বাধীন দেশ, একটি লাল-সবুজের পতাকা।

যুদ্ধকালে মা ও বড় ভাই তারেক রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর শৈশবের আখ্যান। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশার দিনগুলো তাঁর জীবনের অন্যতম বড় ট্র্যাজেডি হলেও সেগুলো বিস্মৃতি হয়ে যায়। তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি বন্দিত্ব কিংবা মুক্তির আনন্দ।

কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দেশ ও দেশের মানুষ তাঁর একান্তই আপন। একটি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশের সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন আর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তাই তো নিভৃতচারী কোকো বেছে নিয়েছিলেন ক্রীড়াজগেক। একজন রাজপুত্র, যিনি কি না চাইলেই ক্ষমতার ভেতর থেকে আরাম-আয়েশে জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাষ্ট্র সংস্কারের পথ।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন একজন সুদক্ষ ক্রীড়াশিল্পীর মতো।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর জীবনটা ছিল বৈচিত্র্যময়। তাঁর মা ও ভাইয়ের সঙ্গে যখন মুক্তি পান তখন তাঁর বয়স মাত্র দুই বছর চার মাস চার দিন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের সময় তাঁর বাবা জিয়াউর রহমান বন্দি হন এবং আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখনো তিনি মাত্র ছয় বছরের শিশু! এমনকি ১৯৮১ সালে বাবা জিয়াউর রহমান যখন শহীদ হন তখন তিনি মাত্র ১১ বছরের কিশোর! এই অল্প সময়ের মধ্যে কোকোর জীবনে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগই বিয়োগান্তক, যা তাঁর মনোজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যদিও তিনি এসবের কিছুই সেভাবে কখনোই প্রকাশ করেননি।

অবুঝ শৈশবেই ১৯৭১-এ পাক-হানাদার বন্দিশালায় আটক হওয়ার পর দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্দি হন। ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

আরাফাত রহমান কোকো ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাধারণ ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক অবদান রাখলেও তিনি ছিলেন সর্বদা প্রচারবিমুখ। ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে থাকাকালীন ক্রিকেট রাজনীতিমুক্তকরণ যেমন করেছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করে স্থাপন করেন অনন্য নজির।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের বেশির ভাগই সরাসরি ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু কোকো ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে দ্বিতীয় বিভাগে খেলাটা পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মতো বিনয়! এ ধরনের বিনয় তাঁর পুরো ক্রীড়া সংগঠক জীবনে লক্ষ করা যায়।

যেমন—ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাঁকে ইচ্ছা তাঁকেই বোর্ড সভাপতি করতে পারত। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত ব্যবহার করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন তিনি। কিন্তু কোকো তা না হয়ে বোর্ডের অধীনে ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমুলে বদলে ফেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে। তিনি কখনো তাঁর অধিকারের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরির পাইপলাইনের সূচনা হয় তাঁর হাত দিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল সাকিব, তামিম, মুশফিক, শুভ, এনামুল জুনিয়র প্রমুখ ক্রিকেটার হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। খেলোয়াড় তৈরির ধারাবাহিক পাইপলাইন তৈরি হয়েছিল এই ডেভেলপমেন্ট কমিটির মাধ্যমে। যার মূল কারিগর ছিলেন কোকো।

আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ক্রিকেট খেলা হতো না। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা এই সময় অলস বসে থাকতেন। এই সমস্যা দূর করতে ২০০৪ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ নেন কোকো। এটিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর করতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরির মাধ্যমে মিরপুর স্টেডিয়ামকে আধুনিকায়ন করেন কোকো। মিরপুর স্টেডিয়ামকে হোম অব ক্রিকেট দেখিয়েই ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বাগতিক দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ।

শুধু তা-ই নয়, দেশের ক্রিকেটকে বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখেন কোকো। তিনি ক্রিকেটকে মিরপুর ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত না করে সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এ ছাড়া ক্ষমতায় থাকার পরও বগুড়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে না করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চান্দু নামে নামকরণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেন।

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আনার ট্রেন্ড চালু করেন কোকো। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেত। ক্রিকেট বোর্ডকে করেছিলেন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকরাই ছিলেন তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডে।

২০০৪ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোকোর কারিশমাতেই। সে সময় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এত বড় আয়োজনের উৎসবে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য সারা দেশে হরতাল ডেকেছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থায়ও এক দিনে ১৫টি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সফল এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কোকো। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ, অরাজনৈতিক ক্রীড়া সংগঠক।

এক/এগারো-পরবর্তী সরকারের আমলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির রোষানলে পড়ে জিয়া পরিবার। তিনি ও তাঁর ভাই তারেক রহমানের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে হয় তাঁকে। সেখানে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাগুলো মাথায় নিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর খবরে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৭ জানুয়ারি সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রায়-কারফিউ অবস্থার মধ্যে বায়তুল মোকাররমে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সেদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ, গোলাপ শাহর মাজার থেকে জিপিও মোড় পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় মানুষ। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেয়।

একজন প্রচারবিমুখ, সাদাসিধে কোকোর শেষ বিদায়ে লাখ লাখ মানুষ সেদিন ডুকরে কেঁদেছিল। বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো কোকোর জানাজাও বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল বিস্ময়কর। একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সব ভয় আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেদিন সাধারণ মানুষ চোখের জলে বিদায় জানায় এই অমর ক্রীড়াশিল্পীকে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।