জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে স্মরণীয় রাখতে কোনো উদ্যোগ নিলে সেগুলোর বাজেট-বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টাকে রাজনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
রোববার (১২ অক্টোবর) রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভের’ ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কাজ করতে গেলেই, জুলাই স্মৃতি জাদুঘর হচ্ছে বা এর বাইরেও যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো বাজেট নিয়ে, কত অর্থ খরচ হচ্ছে সেটা নিয়ে অনেক সময় একটা মহল প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করে।
তিনি বলেন, তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বিগত ফ্যাসিবাদী সময়ে যখন বিভিন্ন ভাস্কর্য হতো, এর থেকে ছোট অবকাঠামো নির্মাণেও আমরা দেখেছি ৩০০-৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সেসব নির্মাণের যে কনসালটেনসি, সেই কনসালটেনসিতেই এ পুরো স্মৃতিস্তম্ভে যা খরচ হচ্ছে তা খরচ করা হয়েছে। তখন ফ্যাসিবাদের ভয়ে হোক কিংবা তাদেরকে সমর্থন দিয়েই হোক এ লোকগুলোকে আমরা কথা বলতে দেখতাম না। অর্থ নিয়ে, বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখতাম না। এখন তাদেরকে প্রশ্ন তুলতে দেখি, কারণ এটা জুলাই নিয়ে হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, তাদের এই প্রশ্ন তোলা কোনোভাবেই জনগণের অর্থের প্রতি বা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করেন বলে আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি তারা এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যাতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে স্মরণে রাখার মতো কোনো কাজ না করা যায় সেই জন্য একটা চাপে রাখার চেষ্টা করে।
জুলাইয়ের স্মৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করে আসিফ মাহমুদ বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ দেড় হাজারের বেশি জুলাই শহীদ এবং ৩০ হাজারের বেশি আহত যারা আছে তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করবো। কোনো ধরনের অপচেষ্টা আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।
ওসমানি উদ্যানে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভের কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ
মূল জুলাই স্মৃতিস্তম্ভটি একটি বৃত্তাকার বেদির ওপর নির্মিত হবে। স্তম্ভটি দ্বিপার্শিয় প্রতিসম। এর দুই পাশে চারটি করে আটটি আয়তাকার পারসিভড কলাম। মাঝখানে একটি বৃত্তাকার কলাম। দুইপাশের আটটি কলাম মূলত একটি ধারাবাহিক আবদ্ধ রেখা যা মাঝখানের বৃত্তাকার কলামের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করেছে এবং ১৬টি পয়েন্টে কোণ তৈরি করে ডিরেকশন পরিবর্তন করেছে। কন্টিনিউয়াস ক্লোজ লাইন এদেশের মানুষের আত্মমর্যাদা ও গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামকে রিপ্রেজেন্ট করে।
আপতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান আটিটি স্তম্ভ যা এ মনুমেন্টে প্রকৃত অর্থে ইন্টারকানেকটেড, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মতাদর্শীক ভিন্নতা ও বৈচিত্র সত্ত্বেও জুলুম ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে তার রিপ্রেজেন্টেশন করে। ধারাবাতিক রেখাটি ওপরের দিকে স্বতন্ত্র থাকলেও নিচের দিকে একটি চলারপথে দুইবার দুইডিরেকশনে অতিক্রম করে একটি মিলনবিন্দু তৈরি করে যেখান থেকে বৃত্তাকার কলামটি দণ্ডায়মান হয়।
এ কলামটি স্বতন্ত্র যা ঐতিহাসিক ১ দফার রিপ্রেজেন্টশন করে। এ কলামের ওপরের অংশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত প্রতিটি শহীদের নাম খোদাই করা থাকবে। এ মনুমেন্টে শহীদদের একটি বর্গে সীমাবদ্ধ না করে বরং প্রতিটি শহীদের নাম আলাদাভাবে উপস্থাপনের নীতিগ্রহণ করা হয়েছে। এখানে প্রতিটি ব্যক্তির স্বাতন্ত্র ও ডিগনিটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিসরে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
স্মৃতিস্তম্ভের বৃত্তাকার বেদির পাশে একটি অর্ধবৃত্থাকার দেয়ালের উতল ও অবতল দুই পাশে বর্ণনামূলক রিলিফ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে। উত্তল পাশে চারটি প্যানেল থাকবে। ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ঘটনাবলী চারটি স্বতন্ত্র প্যানেলে তুলে ধরা হবে। অবতল অংশে ১টি প্যানেল যেখানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত ঘটনাবলী ধারাবাহিকভাবে ফুটিয়ে তুলা হবে। এই ভাস্কর্যের মধ্যদিয়ে ২৪ কে বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়মুক্তি ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ঐতিহাসিক লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ওসমানী উদ্যানে নির্মিত জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে প্রবেশের জন্য দুটি গেট নির্মাণ করা হবে। একটি সচিবালয়ের দিক থেকে উদ্যানের প্রবেশপথে অন্যটি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দিক থেকে উদ্যানের প্রবেশ পথে। গেটটি অ্যাম্বিগ্রামের আদলে ইংরেজি ২৪ ও ৫ সংখ্যাটির সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে যা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন ৫ আগস্টকে সিম্বলাইজ করে।
স্মৃতিস্তম্ভের প্রবেশ পথের দুই পাশে ১০টি করে ২০টি ঘনক আকৃতির ফলক থাকবে। এখানেও প্রত্যেক শহীদের নাম খোদাই করা থাকবে। শহীদ পরিবারগুলো এখানে তাদের হারানো প্রিয়জনদের নামগুলো খুঁজে পাবে এবং জনগণ তাতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। ল্যান্ডস্কেপ পরিকল্পনায় উদ্যানে প্রত্যেক শহীদের নামে একজন। উদ্যানবিদের পরামর্শক্রমে প্রত্যেক শহীদের স্মৃতির উদ্দেশে একটি করে বৃক্ষ রোপণের প্রস্তাব করা হবে। ফলকগুলোর পাশে এমনভাবে কৃষ্ণচূড়া বা বৃহাদাকার ফুলগাছ রোপণের পরিকল্পণা করা হয়েছে যাতে প্রাকৃতিকভাবে ফলকগুলোতে প্রতিটি ঋতুতে ফুল বিছিয়ে থাকে।
এমইউএম/জেএইচ